দিনলিপি - Atik Ullah
দিনলিপি-১৭৯৮
(০৯-০৯-২০২১)
হিফজী মিনাল কুরআন
(সুইটহার্ট কুরআন’ বই থেকে নেয়া)
-
আই লাভ কুরআনে নামটা ছিল ‘হিযবী মিনাল কুরআন’। হিযব বলা হয় দৈনিক তিলাওয়াতের জন্য যেটুকু নির্ধারণ করা হয়। এটাকে ‘বিরদ’-ও বলা হয়। যেমন আমি ঠিক করেছি, প্রতিদিন একপারা করে তিলাওয়াত করব, তাহলে আমার হিযব হলো একপারা। আমার বিরদ একপারা। হিফজ মানে মুখস্থ করা। কুরআন কারীম মুখস্থ করাকেই সাধারণত ‘হিফজ’ বলা হয়। আমরা হিযব ও হিফজ উভয়টা নিয়েই কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছি। শিরোনামের অর্থ, আমার কুরআন হিফজ। রাব্বে কারীম আমাদের হাফেজে কুরআন বানিয়ে দিন। নিয়মিত তাদাব্বুরের সাথে হিযব আদায়ের তাওফীক দান করুন।
১. কুরআন কারীম আল্লাহর দেয়া এক অপূর্ব নেয়ামত। জীবন চলার পথে নানা ঘাত-প্রতিঘাত আসে। পদে পদে উঠতি-চড়তি সামনে পড়ে। শারীরিক-মানসিক নানান সমস্যা-অসুবিধে। এসব বাধাবিঘ্ন মনমানসিকতা, চিন্তাচেতনায় গভীর ছাপ রেখে যায়। অনেক সময় আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্তও হয়ে পড়ি। জীবনের গতিপথ ব্যাহত হয়ে পড়ে। এই বিপর্যয় থেকে বাঁচার সহজতর একটি উপায় হলো—দৈনিক হিযব/বিরদ নিয়মিত আদায় করা। দৈনিক হিযবুল কুরআন সব ধরনের মানসিক সমস্যা দূর করার মহৌষধ। মানসিক বিপর্যয় কোনো সুফল বয়ে আনে না। নিত্যদিনের বিরদুল কুরআন আদায় আমাকে অপার্থিব এক কুরআনি জগতে নিয়ে যাবে। এই কুরআনি জগৎ দৃশ্যমান জগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই জগতের সবকিছুই আখেরাতের চিরন্তন জগতের সাথে সম্পৃক্ত। কুরআনের সাথে জড়িয়ে থেকে, আমি একই সাথে ক্ষণস্থায়ী তুচ্ছ পার্থিব জীবন যাপনের পাশাপাশি চিরস্থায়ী জান্নাতী জীবনও যাপনের সুখ কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারব। কুরআন আমাকে পার্থিব জীবনের নানাবিধ কলুষতার প্রভাব থেকে মুক্ত করে, আখেরাতের পবিত্র জীবনের আস্বাদ দান করবে। নিয়মিত হিযব আদায় আমাকে জীবনের সূচনালগ্নের শুচিশুভ্র জীবন দান করবে। জীবনকে সার্থক করে তুলবে।
২. হিফয শেষ হওয়ার পর, হেফযখানা থেকে বের হওয়ার পর, অনেক সময় ‘মুরাজায়া-তাকরার-দাওরে শিথিলতা এসে যায়। শয়তানই ধীরে ধীরে কৌশলে হিফয ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়। প্রথম প্রথম মনে হয়, এত ইয়াদ, কখনো আমি কুরআন ভুলব না। এটা শয়তানের প্রথম সাফল্য। আস্তে আস্তে আসে ব্যস্ততার অজুহাত। আস্তে আস্তে কুরআন ছুটতে থাকে। একসময় সচেতনতা এলেও, আজ নয় কাল করতে করতে পেরিয়ে যায় আরও কিছুদিন। একদিন জোর করে বসলে দেখা যায়, আগের মতো ইয়াদ নেই বা পুরো ভুলে গেছে। পরিস্থিতি যা-ই হোক, আজ থেকেই মুরাজা‘আ শুরু করে দিতে হবে। অল্প করে হলেও। কুরআন কারীমকে আঁকড়ে ধরতে হবে সার্বক্ষণিক সঙ্গীর মতো।
৩. কুরআন কারীমকে দিতে হবে সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু। কুরআনকে দিতে হবে সবচেয়ে তীক্ষè মনোযোগটুকু। কুরআনকে দিতে হবে সবচেয়ে তীব্র আগ্রহটুকু। কুরআনকে দিতে হবে উদ্যম আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর সময়টুকু। কুরআন নিয়ে বসতে হবে, ফজরের পর দিনের শুরুতে। কুরআনকে সব সময়ই সাথে রাখতে হবে। তবে সব সময় দিনশেষে কর্মক্লান্ত দিবসের শেষে, পরিশ্রান্ত ঘুমন্ত ঢুলুঢুলু সময়টুকু কুরআনের জন্য বরাদ্দ করলে, কুরআন আমার দিকে কতটা অগ্রসর হবে, বলা মুশকিল।
৪. কুরআনে হাফেয বা নিত্য তিলাওয়াতকারী যখন ফজরের পর, মুসাল্লায় বসে কুরআন তিলাওয়াত করতে শুরু করে, তখন তার অনুভূতি কেমন হয়? তার মধ্যে অপূর্ব এক জান্নাতী সুখ খেলা করতে শুরু করে। মনেপ্রাণে এক চাঞ্চল্যকর আরামদায়ক সুবাতাস বইতে থাকে। যেন জান্নাত থেকে এক পশলা সুরভিত দখিনা হাওয়া নেমে এসেছে। যে হাওয়ায় মিশে আছে জান্নাতের ‘নায-নেয়ামত’। যে হাওয়া কানে কানে বলে যায় জান্নাতের সুখসম্ভারের কথা। যে হাওয়া তনুমনে বুলিয়ে দেয় সুখদ পরশ। কুরআন পাঠের সাথে সাথে বান্দা উড়তে থাকে অনন্য এক জগতের দিকে।
৫. বিশেষ কোনো অজুহাতে আজকের নির্ধারিত ‘বিরদ-হিযব’ আগামীর জন্য পেছানো, ভালো লক্ষণ নয়। যত ব্যস্ততাই থাক, বিরদ-হিযব থাকবে প্রধানতম কাজ। ব্যস্ততার অজুহাতে নিত্য বিরদ-হিযব পিছিয়ে দেয়ার মানে, কুরআনকে পিছিয়ে দেয়া। একবার পেছালে, পরে ‘টালবাহানা’ আরও পেয়ে বসবে। একসময় দেখা যাবে, সামান্য অজুহাতেই কুরআন তিলাওয়াত ছেড়ে দিতে হচ্ছে। শয়তানের এসব সূক্ষ্ম অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে হবে অনঢ় অবস্থান নিয়ে। কোনো প্রকার ছাড় না দিয়ে। আমার এখনই ঠিক করতে হবে, আমি কি লড়াই চালিয়ে যাব নাকি ‘থকে’ যাব?
৬. কুরআন কারীম হিফয করতে ইচ্ছুকদের প্রতি অভিজ্ঞদের পক্ষ থেকে তিন নসীহত :
১. নতুন হিফযের পরিমাণ কম রাখা।
২. বেশি বেশি তাকরার পুনরাবৃত্তি বা আওড়ানো।
৩. উভয় কাজ নিয়মিত করতে থাকা।
৭. নিজের প্রিয়জন, বিশেষ করে পরিবারের কাউকে কুরআন কারীম হিফয করতে দেখা, দুনিয়াতে জান্নাতী নেয়ামত উপভোগের মতো। কুরআন তিলাওয়াত জান্নাতের ত্বরান্বিত ‘নাঈম’। কুরআন তো জান্নাতি ফলের মতো। ইয়া আল্লাহ, আমাদের আপনার কুরআনি অনুগ্রহ দান করুন।
৮. ফজরের পরপর বা রাতের তৃতীয় যাম, কুরআন তিলাওয়াত ও হিফযের সর্বোত্তম সময়। এ-সময় কুরআন তিলাওয়াতের স্বাদ, প্রভাব, কার্যকারিতাই আলাদা। কুরআনের সাথে হৃদয়ের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয় এ-সময়। রাতের তৃতীয় যামে, কলব যেন উন্মুখ হয়ে থাকে কুরআনের জন্য। তীর যেমন উড়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে এঁটে যায়, কুরআনও এই সময় হৃদয়পটে এঁটে যায়। কলবে গেঁথে যায়।
৯. হিফযের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় কয়েকটি বস্তু,
১. আল্লাহর প্রতি ইখলাসে ঘাটতি থাকা। ইখলাস মানে শুধু আল্লাহর জন্যই কোনো কিছু করা।
২. হিফযের সময় একমুখী হতে না পারা। মোবাইল বা অন্যকিছুর প্রতি এককান খাড়া থাকা।
৩. কোনো সময় নির্ধারণ না করে, পরিকল্পনাহীন সময় নিয়ে হিফয করতে বসা। সবচেয়ে ভালো হয়, আধাঘণ্টার বেশি একটানা নতুন ‘সবক’ হিফয না করা।
৪. ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে হিফয করতে বসা। হিফযের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টাই বরাদ্দ রাখতে হবে।
১০. আমি আজ শয়তানকে প্রতিরোধ করতে পারছি না, সামান্য ছুতোয় কুরআনের ‘বিরদ’ ছেড়ে দিচ্ছি, নিয়মিত পঠিত ‘হিযব’ না পড়ে দিন পার করে দিচ্ছি, আগামীকাল শয়তান আরও বড় অজুহাত হাজির করবে না, এর নিশ্চয়তা কোথায়? কোনো ক্রমেই ‘হিযব’ ত্যাগ করা যাবে না।
১১. নিয়মিত বিরদ আদায়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কয়েকটি বিষয়,
১. একদিনেই সব তিলাওয়াত করে ফেলার চেষ্টা করা। আগ্রহ থাকতে থাকতে তিলাওয়াত সমাপ্ত করা। আগ্রহের শেষবিন্দু পর্যন্ত তিলাওয়াত না করা।
২. মস্তিষ্ক অন্যকিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় বিরদ আদায় করতে বসা। সবচেয়ে ভালো হয় ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর তিলাওয়াত করতে বসা। এই সময় মনমেজায পরিচ্ছন্ন থাকে।
৩. কখন সূরাটা শেষ হবে, এই চিন্তাতাড়িত হয়ে তিলাওয়াত না করা। ধীরেসুস্থে তিলাওয়াত করতে থাকা।
১২. সারাদিনের এলোমেলো রুটিনকে ফেলেগেঁথে বিন্যস্ত করে তুলতে হবে। ছড়ানো-ছিটানো সময়গুলো একসুতোয় গাঁথতে হবে। সময়ের মালায় নানা কর্মপুঁতির ফাঁকে ফাঁকে কুরআনি মুক্তোও গেঁথে দিতে হবে। কুরআন পড়তে হবে সর্বোচ্চ আগ্রহে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে। সর্বোচ্চ দামি সময়ে। দুনিয়া হামাগুড়ি দিয়ে নয়, দৌড়ে আসবে আমার দিকে।
১৩. অনেকেই নিত্যদিনের ‘হিযব’ তিলাওয়াতে বাধার সম্মুখীন হন। নিয়মিত ‘বিরদ’ আদায় করা হয়ে ওঠে না। সহজ পদ্ধতি হচ্ছে, প্রথমে অল্প করে নির্ধারণ করা। শুরুতে পাঁচ পৃষ্ঠা। দ্বিতীয় সপ্তাহে বা পক্ষে আধাপারা। এভাবে বাড়াতে থাকা। মনকে তিলাওয়াতে অভ্যস্ত করে তুললে পরে আর সমস্যা হয় না। মনকে তিলাওয়াতপোষ করে তুলতে হয় ক্রমান্বয় পদ্ধতি অবলম্বন করে। পরীক্ষা করে দেখতে পারি, ইন শা আল্লাহ সন্তোষজনক ফল আসবেই। কুরআন কাউকে খালি হাতে ফেরায় না।
১৪. একজন হাফেযের জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো, আশেপাশে হিফয শোনানোর মতো একজন মানুষ থাকা। পরিবারের বা বাইরের। যে আগ্রহ করে তিলাওয়াত শুনবে। কখনোই বিরক্তি অনুভব করবে না। শুনতে বললে দ্বিরুক্তিও করবে না। তার মিলবে শোনা ও তিলাওয়াতের দুই প্রকার সওয়াব।
১৫. কখনো দেখা যায়, এক ঘণ্টায় তিন পারা তিলাওয়াত হয়ে গেছে। কখনো কুরআন তিলাওয়াত করতে বসলে, আধা ঘণ্টাও সহজে কাটতে চায় না। তিলাওয়াতও এগোয় না। এটা কেন হয়? কলবের ওপর চেপে বসা গুনাহের কারণে। অথবা খালেস নিয়তের অভাবে আমলটা বাতিল হয়ে যায়। আমল করা দুর্বহ হয়ে যায়।
১৬. যে চায়, কুরআন তার জন্য এমন নূর-হেদায়াত-ইলমের দরজা খুলে দিক, তাহলে তাকে দুটি কাজ করতে হবে।
১. কুরআন কারীম পড়তে হবে হেদায়াত লাভের উদ্দেশ্যে। প্রতিটি শব্দ পড়ার সময় মনে হাজির-নাজির রাখতে হবে, এই শব্দে আমার জন্য হেদায়াত রেখে দেয়া আছে। আমি আপাতত না বুঝলেও, আল্লাহর কাছে আমি এই শব্দে নিহিত হেদায়াত প্রার্থনা করছি।
২. দীর্ঘসময় ধরে কুরআনে তাকিয়ে থাকতে হবে। একটি আয়াত আওয়াজ করে করে পড়ার পর, চুপটি করে দীর্ঘসময় আয়াতখানার দিকে তাকিয়ে ভাবতে হবে, রাব্বে কারীম এই আয়াতে আমাকে কী বলতে চেয়েছেন। রবী বিন সুলাইমান রহ. বলেছেন, আমি ইমাম শাফেঈ রহ. এর দরবারে যতবার গিয়েছি, প্রায় সব সময় তার সামনে কুরআন কারীম খোলা দেখতে পেয়েছি। তাকে কুরআনে নিমগ্ন পেয়েছি।
১৭. প্রতিদিনের ‘বিরদ’ আদায়কে কষ্টকর রুটিন মনে না করা। অনিচ্ছা আর অনাগ্রহ নিয়ে, না পারতে মন শাসিয়ে কষিয়ে, মনের ওপর জোর খাটিয়ে বিরদ আদায় না করা। বিরদকে জাগতিক ও পারত্রিক উন্নতির মাধ্যম মনে করে পরম আগ্রহ নিয়ে বিরদ আদায় করা। বিরদকে নিজের প্রাণশক্তির আধার মনে করা। বরকত আর সৌভাগ্যের উৎস মনে করা। তাড়াহুড়ো করে কোনোরকমে আজকের বিরদ শেষ করার জন্য উঠেপড়ে না লেগে, ধীরেসুস্থে মহব্বতের সাথে তিলাওয়াত করতে থাকা।
১৮. পড়তে বা লিখতে বসলে, কোথাও আটকে গেলে, শব্দ বা বাক্যের অর্থ না বুঝলে, লেখার সময় উপযুক্ত শব্দ মাথায় না এলে, মুসহাফ খুলে তিলাওয়াত শুরু করে দেয়া। কিছুক্ষণ তিলাওয়াত করলে, আপনাআপনি মাথার জট খুলে যায়। লেখা বা পড়ায় নতুন গতি আসে।
১৯. আমি ভালো হাফেয হয়েছি। ভালো মুফাসসির হয়েছি। কুরআন বিষয়ে ভালো কথা বলতে পারি। লিখতে পারি। চারপাশ থেকে মানুষের প্রশংসা ভেসে আসতে শুরু করেছে। এসব দেখে আমার মধ্যে বাষ্প জমছে। নিজের মধ্যে হামবড়া ভাব সৃষ্টি হয়েছে। এটা আমার পতনের সূচনা। আমাকে আল্লাহ যে কুরআনি নূর দান করেছেন, সেটা ছিনিয়ে নেয়ার সময় হয়েছে। মানুষের সামান্য কথাতে অহংকারী হয়ে পড়ার মতো ন্যক্কারজনক স্বভাব আর হতে পারে না। বিশেষ করে অল্পবয়েসে হাফেয হয়ে গেলে, এই সমস্যা তৈরি হয়। এখন তো একটু ভালো ইয়াদ হলে, গলা একটু সুন্দর হলে, ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের ত্রিমুখী প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়ে যায়। অনেক হাফেযের শিক্ষাজীবন এভাবেই শেষ হয়ে যায়। পড়াশোনা আর আগায় না। মিডিয়ার চাকচিক্যময় প্রচারে ছোট্ট হাফেয সাহেব বেসামাল হয়ে পড়েন। আল্লাহর কালাম ধারণ করেও কুরআনের নূর থেকে বঞ্চিত হওয়া বড়ই কষ্টের।
২০. অভ্যেস না থাকলে, প্রথম প্রথম তিলাওয়াত অনেক ভারী মনে হয়। জিহ্বা দিয়ে উচ্চারণ করতে কষ্ট হয়। এমনকি কলবও কুরআনকে গ্রহণ করতে চায় না। দুয়েক আয়াত পড়তে-না-পড়তেই ক্লান্তিবোধ হয়। জিহ্বা জড়িয়ে আসতে চায়। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। একটু পরেই হাঁপ ধরে যায়। যারা দৈনিক হিযব আদায় করার সংকল্প করেছে, প্রথম দিকের এমন ক্লান্তি-হাঁপ দেখে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে আসবে। শুরুতে তিলাওয়াতের পরিমাণ অল্প রাখতে হবে। ধীরে ধীরে জিহ্বা, কলব তৈরি হয়ে উঠবে। প্রথম দিকে সবর করে তিলাওয়াত অব্যাহত রাখতে হবে। একসময় সহজ হয়ে যাবে। একপারা, দুইপারা, তিনপারা বা আরও বেশি তিলাওয়াত অনায়াসে শেষ করা যাবে।
২১. কুরআনে আমার সমস্যার সমাধান আছে। এই সমাধানের ধরন কিছুটা ভিন্ন। কুরআন সরাসরি হুবহু নাম চিহ্নিত করে সমাধান বাতলায় না। কুরআন আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করে। তবে অনেক সময় এমন হয়, কুরআন আমাকে আক্ষরিক অর্থে সুস্পষ্ট পথ দেখিয়ে দেয় না। কুরআনের ‘আচরণগুলো’ হয় সাধারণত গভীর।
ধরা যাক আমি একটি সমস্যার সম্মুখীন হলাম। আল্লাহর কাছে উদ্ধারের দু‘আ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি কুরআন তিলাওয়াত করছি। মুক্তির উপায় খুঁজছি কুরআনে। পড়তে পড়তে কোনো প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক কোনো আয়াত সামনে আসে, যার প্রভাবে দীর্ঘদিনের লালিত কোনো ভ্রান্ত ধারণা, অভ্যেস বা স্বভাবে পরিবর্তন আসে। আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে। কখনো জ্ঞাতসারে, কখনো অজ্ঞাতসারে। কখনো তিলাওয়াত করতে করতে মনে ভাবনার উদয় হয়, আমি যে পথে চলছি, সেটা সঠিক নয়। পাশাপাশি সঠিক পথ সম্পর্কেও একটা ধারণা জন্মায়।
কুরআন চট করে, দুম করে, তেলেসমাতি কা- আর ভোজবাজির মতো আকস্মিক কোনো পরিবর্তন ঘটায় না। কুরআন রূঢ়ভাবে কিছু করে না। কুরআন কাজ করে নরমকোমলভাবে। ধীরেসুস্থে অথচ কার্যকর, ফলপ্রসূ আর অব্যর্থভাবে।
২২. দৈনিক হিযব আদায়ের সময়, আমার প্রধান মনোযোগ পারা-সূরা-পৃষ্ঠাসংখ্যার দিকেই যেন কেন্দ্রীভূত না হয়ে পড়ে। একলাইন পড়তে-না-পড়তেই কদ্দূর পড়লাম আর কদ্দূর বাকি আছে, এই হিসেবে যেন ব্যতিব্যস্ত না হয়ে পড়ি। তিলাওয়াত করতে বসলে, হিযব শেষ করাই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য না হয়ে দাঁড়ায়। আমি গুনে গুনে তিলাওয়াত করলে, আল্লাহর পক্ষ থেকে বিনিময়ও তেমন হবে।
২৩. আমার তিলাওয়াত হতে হবে গভীর। কুরআনের মাঝে ডুবে যেতে হবে। এমনভাবে কুরআনে ডুব দিতে হবে, যেন আমি আর কুরআন ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কারও অস্তিত্ব নেই। একাকী নির্জনবাসের মতো। কুরআনকে সাথে নিয়ে জনতার মাঝে নির্জনতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। প্রতিটি আয়াত হয়ে উঠবে পরম সঙ্গী। চিন্তাচেতনায় থাকবে শুধুই কুরআন। এ জন্য কুরআন নিয়ে বসার সময়টাও এমন হবে, যখন লোকজনের আনাগোনা থাকে শূন্যের কোঠায়। সব ব্যস্ততা ফুরিয়ে যায়। এমন হলেই কুরআন হয়তো কিছু রহস্য আমার সামনে উন্মোচন করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা আমার প্রতি দয়া করলেও করতে পারেন।
২৪. কুরআন কারীম সাধ্যানুযায়ী সুর করে পড়াই সুন্নত। যথাসম্ভব বিশুদ্ধ তাজবীদে, আপন যোগ্যতার সর্বোচ্চ সীমায় সুন্দর করে তিলাওয়াত করলে, কুরআন তিলাওয়াতে বাড়তি মনোযোগ ও আগ্রহ সৃষ্টি হয়। শয়তানের ওয়াসওয়াসা কাছে ঘেঁষতে পারে না। কুরআনের প্রতি বান্দার আগ্রহ দেখে আল্লাহ তা‘আলাই শয়তান ও তার সাঙ্গপাঙ্গকে তিলাওয়াতকারী থেকে দূরে হটিয়ে দেন,
ٱلَّذِی یُوَسۡوِسُ فِی صُدُورِ ٱلنَّاسِ مِنَ ٱلۡجِنَّةِ وَٱلنَّاسِ
যে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়, সে জিনদের মধ্য হতে হোক বা মানুষের মধ্য হতে (আন-নাস)
২৫. সফরে-ঘরে সর্বাবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত অব্যাহত রাখা উচিত। কোনো অবস্থাতেই তিলাওয়াত ছাড়া উচিত নয়। এটাই উম্মাতে মুহাম্মদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অন্য কওমের কথা বলে আমাদেরও উদ্বুদ্ধ করছেন,
لَیۡسُوا۟ سَوَاۤءً مِّنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَـٰبِ أُمَّةٌ قَاۤىِٕمَةٌ یَتۡلُونَ ءَایَـٰتِ ٱللَّهِ ءَانَاۤءَ ٱلَّیۡلِ وَهُمۡ یَسۡجُدُونَ
(তবে) কিতাবীদের সকলে এক রকম নয়। কিতাবীতের মধ্যেই এমন লোকও আছে, যারা (সঠিক পথে) প্রতিষ্ঠিত, যারা রাতের বেলা আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে এবং তারা (আল্লাহর উদ্দেশ্যে) সিজদাবনত হয় (আলে ইমরান, ১১৩)।
২৬. যেকোনো কাজে সফল হতে গেলে সবর লাগে। দৈনিক হিযব আদায়ে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার জন্যও প্রথম কিছুদিন সবরের সাথে লেগে থাকতে হয়। হিফয করতে গেলে সবরের প্রয়োজন হয়। হিফয শেষ হওয়ার পর, ইয়াদ ধরে রাখতেও সবরের প্রয়োজন হয়। কুরআনের সাথে লেগে থাকার জন্য সবরের বিকল্প নেই।
২৭. আল্লাহ তা‘আলার কাছে কুরআনের অনেক সম্মান। যারা কুরআন নিয়ে থাকেন, তাদেরও আল্লাহ তা‘আলা অনেক সম্মান দান করেন। হাসাদ বা হিংসা কোনো অবস্থাতেই বৈধ নয়। হাসাদ না বলে, গিবতা বা ঈর্ষা বলা যেতে পারে। দুটি বিষয়ে ঈর্ষা বৈধ, একব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন দান করেছেন। সে ব্যক্তি দিনরাত সলাতে কুরআন তিলাওয়াত করে। আরেক ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পদ দান করেছেন। মানুষটা দিনরাত এক করে দান-খয়রাত করে। এই দুই ব্যক্তির আমল নিয়ে ঈর্ষা করা যেতে পারে। নিজেও এমন হওয়ার আশা পোষণ করা যেতে পারে (মুত্তাফাক)।
২৮. বয়েস হয়েছে, এতদিন পর ভালো ইয়াদ থাকার কথা নয়, তবুও পুরো কুরআন টাটকা ইয়াদ। অবাক লাগল। রহস্যাটা কী? সারাদিন খুবই ব্যস্ত থাকেন। আলাদা করে তিলাওয়াত করতে দেখি না। নামাযের আগে-পরে হয়তো কিছু তিলাওয়াত করেন। ইয়াদের রহস্য তিনিই ভাঙলেন। বসে তিলাওয়াত করতে না পারলেও, হাঁটাচলায় তিলাওয়াত করেন। বিশেষ করে মাদরাসায় আসা-যাওয়ার পথে প্রতিদিন অনেকটা তিলাওয়াত হয়ে যায়। অথচ দেখে মনেই হতো না, তিনি এই সময় তিলাওয়াত করেন বা করতে পারেন। আল্লাহর কালামকে আল্লাহর বান্দারা কতভাবে যে সংরক্ষণ করে!
২৯. আমি কুরআন হিফয না করলে, তবে আর করবে কে? কুরআন আমার, আমি কুরআনের। আমার মা-বাবার সম্মান সমাদর করার দায়িত্ব আমার। আমার হিফয আখেরাতে মা-বাবার জন্য সম্মান বয়ে আনবে। আল্লাহর দরবারে মা-বাবার মর্যাদা বুলন্দ করবে। মা-বাবার সুবিধার্থে আমি এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে না নিলে, কে নেবে? আমি আমার মা-বাবার দিকে তাকিয়ে হলেও হিফযুল কুরআন শুরু করে দিতে পারি। সময়-মেধা-সুযোগ-বয়েসের কারণে যদি হিফয শেষ করে নাও উঠতে পারি, সন্তানরা আমাকে দেখে প্রেরণা লাভ করবে। সন্তানের হিফয আমার পরকালের পাথেয়। দুনিয়ার কত কিছুই তো আমার পছন্দের তালিকায় থাকে। আল্লাহর কালামের হিফয কেন এই তালিকায় স্থান পাবে না? আমার জীবনের প্রধানত লক্ষ্য কেন হিফযুল কুরআন নয়, এই প্রশ্ন কি নিজেকে কখনো করেছি?
৩০. কলব শক্ত হয়ে আছে? অন্তর নরম করার সবচেয়ে সহজ কার্যকর আর সুন্দর পদ্ধতি হচ্ছে নিজে তিলাওয়াত করা বা অন্যের তিলাওয়াত শোনা। তাদাব্বুরের সাথে। কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণে আছে অপূর্ব প্রশান্তি। অভিজ্ঞতা না থাকলে, বলে বোঝানো কঠিন।
৩১. বয়েস হয়ে গেলে, ব্যস্ততা বেড়ে গেলেও হিফয করার ফলপ্রসূ পদ্ধতি আছে। শেষদিক থেকে শুরু করতে হবে। মুখস্থ না হওয়া পর্যন্ত একটানা শুনে যেতে হবে। শোয়ার সময়। খাওয়ার সময়। পাশাপাশি কুরআন কারীম হাতে নিয়েও পড়তে হবে। প্রথমে ছোট ছোট সূরা, তারপর ধীরে ধীরে বড় বড় সূরা। মুখস্থ হলে প্রথমে নিজেকে শোনাতে হবে, তারপর অন্যকে। সুযোগ পেলেই সূরাটা পড়তে হবে। সলাতে পড়তে হবে। চলতে ফিরতে পড়তে হবে। শুয়ে শুয়ে, বসে বসে, হাঁটতে হাঁটতে পড়তে হবে। অর্থ বুঝে বুঝে পড়তে হবে। চিন্তা করে করে, তাদাব্বুরের সাথে পড়তে হবে। তাহলে একবার মুখস্থ করা সূরা, সহজে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
৩২. কুরআনের মৌলিক পাঠ একজন শিক্ষকের কাছে হওয়া বাঞ্ছনীয়। শুরুতেই শিক্ষক নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। মৌলিক দক্ষতার জন্য, জীবনের শুরুতে, একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের শিষ্যত্ব বরণ করে নেয়াই নিরাপদ। আর এই পর্বটা দীর্ঘমেয়াদে হওয়া উপকারী। তাহলে শুধু শব্দ নয়, অর্থও শেখা হয়ে যাবে।
৩৩. গুনাহ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে হিফযের। অনেক দক্ষ হাফেযও গুনাহের কারণে কুরআন ভুলে যায়। গুনাহের প্রভাবে কী হয়? কুরআনের প্রতি উদাসীনতা তৈরি হয়। কঠিন কঠিন পরিস্থিতি সামনে আসতে থাকে। ফলে কুরআন নিয়ে বসার সুযোগ হয় না। কুরআন থেকে দূরে সরার কারণে, একের পর এক সমস্যা আসতে থাকে। এক সমস্যার হাত ধরে আরও নানা সমস্যা হাজির হয়। এতসব ঘটনা ঘটতে থাকে অগোচরে। তার মনে হতে থাকে, সমস্যাগুলো এমনি এমনি ঘটছে। কুরআননিরোধী গুনাহগুলো সাধারণত গোপন হয়ে থাকে। প্রথম দিকে এগুলোকে গুনাহ বলেই মনে হয় না। আমার সতর্ক হওয়া উচিত, আমিও এমন কোনো গুনাহে লিপ্ত নই তো, যা আমাকে কুরআন কারীম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? আমাকে কুরআন থেকে বিমুখ করে রাখছে?
৩৪. আমি কুরআন অভিমুখী হতে পারছি না, নিয়মিত কুরআন নিয়ে বসতে পারছি না। কুরআনি ওযীফা আদায় করতে পারছি না। দৈনিক হিযব/বিরদ আদায় করতে পারছি না, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও উপায় হচ্ছে না। এর একটাই কারণ, আমার গুনাহ আমাকে কুরআন কারীম থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। গুনাহ আমার আর কুরআনের মাঝে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। গুনাহ আমাকে কুরআনের কাছে যেতে বাধা দিচ্ছে। গুনাহ আমাকে কুরআন বুঝতে বাধা দিচ্ছে। গুনাহ আমাকে কুরআন অনুযায়ী আমল করতে, জীবন গড়তে বাধা দিচ্ছে।
৩৫. একজন হাফেযে কুরআন কখনোই অন্যের প্রশংসা বা নিন্দায় প্রভাবিত হয় না। আত্মমুগ্ধতা বা আত্মহংকারে ভোগাও কুরআনে হাফেযের জন্য শোভনীয় নয়। নিজের সুন্দর সুর নিয়ে, নিজের হিফযের যোগ্যতা নিয়ে অহংকারে ভুগবে না। কুরআন পড়তে পারা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ (لَّوۡ شَاۤءَ ٱللَّهُ مَا تَلَوۡتُهُۥ عَلَیۡكُمۡ وَلَاۤ أَدۡرَىٰكُم بِهِ) আল্লাহ চাইলে আমি এ কুরআন তোমাদের সামনে পড়তাম না এবং আল্লাহ তোমাদের এ সম্পর্কে অবগত করতেন না (ইউনুস, ১৬)। আল্লাহ চাইলে আমার কুরআনি যোগ্যতা যেকোনো মুহূর্তে ছিনিয়ে নিতে পারেন। আমার সতর্ক থাকা উচিত।
৩৬. আমি যত ভালো হাফেযই হই, যত ভালো মুফাসসিরে কুরআনই হই, আমার মধ্যে কখনোই যেন এই চিন্তা না আসে, আমি হিফযের চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে গেছি। আমি কুরআনের সমস্ত তাফসীর-তরজমা জেনে গেছি। আমি যাবতীয় সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে গেছি। কুরআনি যোগ্যতা যদি আমার মধ্যে বিনয় সৃষ্টি না করে, তাহলে বুঝতে হবে, আমি শয়তানের পাল্লায় পড়ে আছি।
৩৭. কুরআন তিলাওয়াতকারীর এটা জানা থাকা উচিত, কুরআন কারীমে যা-কিছু বলা হয়েছে, তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে। কুরআনের প্রতিটি হুমকি-ধমকির উদ্দেশ্যও সে। কুরআনে গল্পগুলো এমনি এমনি বলা হয়নি। এগুলো শিক্ষা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে।
(মিনহাজুল কাসিদীন, আল্লামা ইবনে কুদামাহ রহ.)।
৩৮. কুরআন কারীম আগাগোড়া রহমত। আল্লাহ তা‘আলা যদি আমাকে তার কুরআনি রহমত দ্বারা বেষ্টন করে না নেন, তাহলে আমি শেষ। কীভাবে বুঝব আমি তার কুরআনি রহমতের বেষ্টনীতে আছি কি না? যদি দেখি নিয়মিত দৈনিক হিযব আদায় করতে পারছি, ভেতর থেকে কুরআনের বিধিবিধান মেনে চলার পূর্ণ সায় পাচ্ছি, কুরআনের সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগছে, তাহলে ধরে নিতে পারি, আমি আল্লাহর কুরআনি রহমতের বেষ্টনীতে আছি। আলহামদুলিল্লাহ।
৩৯. প্রতিদিন তিলাওয়াত ও হিফযের আগে, নিয়ম করে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে দোয়া করে নেয়া জরুরি। একটু পরপর আল্লাহর তাওফীক চেয়ে দোয়া করা। আমার মেধা ভালো, আমার স্মরণশক্তি প্রখর, আমি মেধাবী—এটা মোটেও কাজ দেবে না, যদি আল্লাহর রহমত অনুগ্রহ না থাকে। তিলাওয়াত তাদাব্বুর ও হিফযের জন্য আমাকে আল্লাহর রহমত চেয়ে আনতে হবে। কারণ, রহমানই আমাকে কুরআন শিক্ষা দেবেন। কুরআন শেখার পেছনে আল্লাহর রহমত গুণই বেশি কার্যকর থাকে
ٱلرَّحۡمَـٰنُ عَلَّمَ ٱلۡقُرۡءَانَ
তিনি তো রহমানই। যিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন (সূরা আর রহমান)।
৪০. কুরআনি রুটিনের কখনো কিছুতেই ব্যতিক্রম করা ঠিক নয়। হিফযের সময় হিফয করতে বসে যাওয়া, হিফয শোনানোর সময়, কমবেশ যতটুকু হিফয হয়েছে শুনিয়ে ফেলা, হিযব আদায়ের সময় হলে সবকিছু স্থগিত রেখে তিলাওয়াতে মশগুল হয়ে পড়া। কোনো কারণে হিযব ছুটে গেলে, ঘুমের আগে হলেও কাযা আদায় করে নেয়া। কুরআনি রুটিন রক্ষায় নাছোড়বান্দা না হলে, কুরআন আসবে না। এলেও থাকবে না।
৪১. যার কাছে কুরআনের একটা হরফও শেখা হয়েছে, তাকে কিছুতেই ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ছেলেবেলা থেকে এই পর্যন্ত, কার কার কাছে আমি কুরআনি শিক্ষা লাভ করেছি? আমার কি মনে আছে? আমি কখনো কুরআনের ভালোবাসায়, কুরআনের শিক্ষকদের কথা স্মরণ করার চেষ্টা করেছি? তাদের জন্য আলাদা করে দোয়া করেছি? তাদের সাথে যোগাযোগ করার কথা ভেবেছি? তাদের খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করেছি? তাদের বিপদাপদে পাশে দাঁড়িয়েছি? কুরআনের প্রতি ভালোবাসার তাগিদেই আমাকে এটা করতে হবে। কোনো কুরআনি শিক্ষকের প্রতি মনে ক্ষোভ, অবজ্ঞা, অবহেলা বা অনীহা থাকলে, কুরআনের জন্যই তাকে ক্ষমা করে দেয়া উচিত। তার ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত।
৪২. একা একা হিফয না করে, একজন শিক্ষকের অধীনে হিফয করা ভালো। আক্ষরিক অর্থে শিক্ষক না পেলে, একজন সহযোগী খুঁজে বের করা তো কঠিন কোনো কাজ নয়। তবে প্রথাগত শিক্ষক হলেই বেশি ভালো। তিনি চাপ দিয়ে পড়া আদায় করে নেবেন।
৪৩. আশেপাশের সবাই কুরআনের প্রতি উদাসীন, এই অজুহাতে নিজেও কুরআনের প্রতি অবহেলার মানসিকতা রাখা ঠিক নয়। সমাজের বেশির ভাগ মানুষ, পরিচিত গ-ির প্রায় সবাই কুরআন হিফযের প্রতি আগ্রহী নয়, এটা কোনো অজুহাত হতে পারে না। আমাকেই আমার ব্যবস্থা নিতে হবে। কুরআনের হাফেয হতে হবে, দৈনিক হিযব আদায় করতে হবে, এটাই হবে আমার প্রধানতম প্রতিজ্ঞা। নিজের স্বার্থেই এটা করতে হবে। আমার আখেরাতকে সাজিয়ে তুলতেই আমাকে কুরআনের পথে পা-বাড়াতে হবে।
৪৪. কুরআনের পথে, হিফযের পথে, দৈনিক হিযব আদায়ের পথে, আমার চেয়ে যারা পিছিয়ে আছে, তাদের প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলার মনোভাব পোষণ করা সীমাহীন ক্ষতিকর। শুরুতে মাঝে এগিয়ে থেকেও কতজন শেষে গিয়ে পিছিয়ে পড়েছে। আমিও সেই দলে পড়ে যাব না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? আমাকে আল্লাহর কাছে বিনয়ের দোয়া করতে হবে।
৪৫. কুরআন হিফযের জন্য প্রচ- শক্তিশালী প্রতিজ্ঞা প্রয়োজন। হিফযুল কুরআন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম যোগ্যতা। শ্রেষ্ঠতম জ্ঞান। শ্রেষ্ঠতম অর্জন। শ্রেষ্ঠতম স্বীকৃতি। যেনতেন চেষ্টায় এই বিশাল সম্মান অর্জন করা সম্ভব নয়। মরিয়া হয়ে না লাগলে, কুরআন সহজে ধরা দেবে না। আর এই দুর্লভ অর্জন এক-দুদিনেই সম্ভবপর হয়ে যাবে না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহর কাছে চেয়ে চেয়ে এই নেয়ামত লাভ করতে হবে।
৪৬. যা হিফয করছি, সেটার অর্থ ও তাফসীর বোঝা খুবই জরুরি। আল্লাহ তা‘আলা নিছক না বুঝে মুখস্থ করার জন্য কুরআন নাযিল করেননি। নাযিল করেছেন কুরআন বুঝে সে অনুযায়ী আমল করতে। আমি যা বুঝতে পারছি না, সেটা অন্ধের মতো হিফয করা, যুক্তিযুক্ত পদ্ধতি নয়। হিফযের জন্য আমি মরণপণ হলে, কুরআন বোঝার জন্য জীবনপণ হতে পারব না কেন?
৪৭. আমাদের দেশে কুরআন হিফযের সনদ নেয়ার প্রচলন নেই। হাদীস শরীফের যেমন সনদ আছে, ইলমুল কেরাতেরও সনদ আছে। হাদীসের সনদে যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত ধারাবাহিকতা বজায় থাকে, কেরাত বা হিফযের সনদেও থাকে। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে কুরআনে হাফেয হওয়ার তাওফীক দিলে, চেষ্টা করব একজন অভিজ্ঞ মুত্তাকী ওস্তাদের কাছ থেকে হিফযের সনদ নিতে। সমস্যা হলো, আমাদের দেশে হিফয সনদ গ্রহণের তেমন প্রচলন না থাকায় বড়ছোট বেশিরভাগ হাফেযের কাছেই হিফযের সনদ নেই। আমরা মাদরাসা বা বোর্ডের সনদের কথা বলছি না। সনদ মানে ‘ইজাযাহ’। আরবে এই সনদের ব্যাপক প্রচলন। অনলাইনেও ইজাযাহ লাভ করা যায়। সবচেয়ে ভালো হয়, হিফযের পাশাপাশি আল্লাহর কাছে ‘বায়তুল্লাহ’ যেয়ারতের তাওফীক চেয়ে দোয়া করা। মক্কা-মদীনা উভয় মসজিদেই সরকারি ব্যবস্থাপনায়, অনেক সনদধারী হাফেয/ক্বারী সাহেবান বসে থাকেন। আগ্রহীগণ তাদের কাছে পড়া শুনিয়ে সনদ গ্রহণ করতে পারেন।
আমিও মসজিদে নববীতে প্রতিদিন ফজরের পর, ২৬০ নম্বর জুতার বাক্সের কাছে, এক ওস্তাদের কাছে বসতাম। কিন্তু সনদ নেয়ার সৌভাগ্য হয়নি। ইয়া আল্লাহ, আমাকে আপনার নবীর দেশে গিয়ে, হিফযের সনদ লাভের সৌভাগ্য দান করুন। এই লেখা যারা পড়বে, তাদেরও তাদের উপযুক্ত ওস্তাদের কাছ থেকে হিফযের সনদ লাভের অপূর্ব সৌভাগ্য দান করুন। আমীন।
হিফযের সনদ বা ইজাযাহ নেয়ার উদ্দেশ্য হলো, আমি কুরআনে হাফেয হয়েছি, এর স্বীকৃতি লাভ করা। আমি এখন অন্যকেও কুরআন শিক্ষা দিতে পারব, এই অনুমোদন লাভ করা। আমি যা শিখেছি, সেটাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের শিক্ষা দিয়েছেন। সাহাবীগণ তাবেয়ীগণকে শিক্ষা দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমিও শিক্ষা লাভ করেছি। আমি সনদের সূত্র ধরে মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হয়ে সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকেই কুরআন শিক্ষা লাভ করেছি। সনদ হাসিলের পেছনে এমন একটা প্রতীকী রূপ থাকে।
আমাদের দেশে কি কোথাও এভাবে সনদ দেয়ার রেওয়াজ বিদ্যমান আছে? কুষ্টিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, ড. এবিএম হিযবুল্লাহ সাহেব, এ-বিষয়ে বেশ উচ্চকিত। তিনি পরিচিত সবাইকে এ-সনদের ব্যাপারে সচেতন করার চেষ্টা করেন। কারী হিসেবে হয়তো অতটা পরিচিত নন। অথচ যোগ্যতার বিচারে তিনি দেশের একজন প্রধানতম কারী। মদীনা ইউনিভার্সিটি থেকে ইলমুল কেরাতে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন। আমাদের জানামতে তিনিই দেশের একমাত্র ইলমুল কেরাতে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ব্যক্তি। রাব্বে কারীম তাকে দুনিয়া আখেরাতে খাইর ও বরকত দান করুন। তার পরিবার-পরিজনকে আমন ও আমানে রাখুন। আমীন।
৪৮. কুরআনি মাদরাসা, হিফযখানাগুলো ওস্তাদের প্রতি সম্মান দেখানোর কথা খুব বলা হয়। বলার দরকারও আছে। পাশাপাশি আরেকটা দিকও গুরুত্বের সাথে বলা দরকার, কুরআনি মাদরাসায় পড়তে আসা তালিবে ইলমরাও সম্মান পাওয়ার হকদার। তারা আল্লাহর মেহমান। তারা আল্লাহর কালাম শিখতে এসেছে। তাদের সম্মান করা মানে, আল্লাহকে সম্মান করা। তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করা মানে আল্লাহর সাথে দুর্ব্যবহার করা। তাদের দোষত্রুটি দুষ্টুমি উৎপাত সাধ্যমতো সবরের সাথে মেনে নেয়ার মাঝেই কল্যাণ নিহিত। অহেতুক শাসন করে, তাদের কুরআনবিমুখ করে দেয়া মহাপাপ।
৪৯. কুরআনের পথিককে সব সময় তার কলবের দিকে তীক্ষè নজর রাখতে হয়। কলবে রিয়া এসে গেল কি না, কলবে অহংকার এসে গেল কি না। আল্লাহর একান্ত বাছাই করা ব্যক্তিরাই কুরআনের পথিক হতে পারে। কুরআনের হাফেয হতে পারে। নিয়মিত দৈনিক হিযব আদায় করতে পারে। এ জন্য শয়তান সর্বশক্তি ব্যয় করে, তাদের পেছনে পড়ে থাকে। আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করাই আমাকে শয়তানের ফাঁদ থেকে বাঁচাতে পারে।
৫০. কুরআন শিক্ষার্থীকে সব সময় তার ওস্তাদের আদব বজায় রাখার প্রতি সতর্কদৃষ্টি রাখতে হয়। বর্তমানে একটা প্রবণতার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। অনেক সময় দীনি বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, যোগ্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে। ইলম শেখার উদ্দেশ্যে নয়। যার কাছে নিয়মিত কুরআন শেখার সুযোগ হয়, নিয়মিত ইলম শেখার সৌভাগ্য হয়, তাকে পরীক্ষা করার জন্য প্রশ্ন করা চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ। নিজেকে কুরআনি ইলম থেকে বঞ্চিত করার পূর্বাভাস। ইলমের পথ পুরোটাই আদব-ইহতিরামের ওপর নির্ভরশীল। সাহাবায়ে কেরাম থেকে এই ধারা চলে আসছে। ইলম আসে আদবের পথে।
৫১. এখন টাকা দিয়ে সনদ কেনা যায়। দুনিয়াবি শিক্ষার মতো, কুরআনের বেলায়ও এমন পন্থা অবলম্বন করা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। যোগ্যতা ছাড়াই সনদ ইজাযাহ লাভ করা, নিজের প্রতি জুলুম করারই নামান্তর। দীনকেও টাকাপয়সা দিয়ে কেনাবেচার বিষয়ে পরিণত করা, কেয়ামতের লক্ষণ। ভুয়া লাইসেন্স বাগিয়ে হাতুড়ে ডাক্তারি করার চেয়েও, টাকায় কেনা সনদ দিয়ে, দীন বেচে খাওয়া আরও বেশি ভয়াবহ।
৫২. পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আনন্দ কী? কুরআনের হিফয সম্পন্ন করার আনন্দ। একজন তালিবে ইলম যখন হিফযের শেষ সবক ইয়াদ করতে বসে, শেষ সবক শোনানো শেষ করে, সেই সময় তার আবেগ উচ্ছ্বাস আর আনন্দের স্বরূপ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। একজন হাফেয পুরো কুরআন হিফয করে, এক আয়াত এক আয়াত করে পড়ে, জান্নাতের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করারই আগাম ট্রায়াল দিলো।
৫৩. কুরআন কারীম হিফয করতে পারা, আল্লাহর অপার অনুগ্রহ। আল্লাহর এই বিরাট অনুগ্রহ লাভ করতে হলে, মরিয়া হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করার বিকল্প নেই। কুরআন হিফযের প্রধান সহায়ক শক্তি দোয়া, ছাত্রের মেধাশক্তি নয়। উঠতে-বসতে আল্লাহর কাছে তাওফীক চেয়ে দোয়া করা। কোনো সূরা সহজে মুখস্থ হতে না চাইলে দোয়ায় মশগুল হয়ে পড়া। কোনো পারা মুখস্থ করার পর ভুলে গেলে, কালবিলম্ব না করে, আল্লাহর দরবারে হাত পেতে বসে থাকা। আমার আত্মনিবেদন দেখে, আল্লাহ তা‘আলার রহমতের সাগরে ঢেউ উঠবে। তিনি আমাকে অনায়াসে হাফেয বানিয়ে দেবেন। ইন শা আল্লাহ।
৫৪. ইমাম দাহহাক রহ. বলেছেন, কেউ যখন কুরআন (হিফয করে বা পড়তে) শেখার পর ভুলে যাওয়ার একমাত্র কারণ ‘গুনাহ’। কুরআনে আছে,
وَمَاۤ أَصَـٰبَكُم مِّن مُّصِیبَةࣲ فَبِمَا كَسَبَتۡ أَیۡدِیكُمۡ
তোমাদের যে বিপদ দেখা দেয়, তা তোমাদের নিজ হাতের কৃতকর্মেরই কারণে দেখা দেয় (শুরা, ৩০)।
কুরআন ভুলে যাওয়ার চেয়ে বড় মুসীবত আর কী হতে পারে?
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা রহ.)।
৫৫. কুরআন তিলাওয়াত ও হিফযে দক্ষতা অর্জনের পথ তিনটি। বেশি বেশি অভিজ্ঞ কারী সাহেবানের কেরাত শোনা। নিজে বেশি বেশি পড়া। যা পড়া হয়েছে, হিফয হয়েছে, আরেকজনকে শোনানো।
৫৬. কুরআন হিফযের পথে সবচেয়ে বড় বাধা আশপাশ। বেশির ভাগ হাফেযে কুরআনই মা-বাবা বা আশেপাশের প্রভাবে কুরআন হিফয করেন। আবার চেষ্টা করেও হাফেয হতে না পারা অধিকাংশ ব্যক্তিও হিফয ছেড়ে দেন, আশেপাশের কথা বা আচরণে প্রভাবিত হয়ে। কুরআন হিফয করতে চাইলে, আশপাশ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। কী হবে এত কষ্ট করে? হাফেয হওয়া ফরয ওয়াজিব কিছুই নয়, কেন এত কষ্ট করছ? তার চেয়ে বরং কুরআন বোঝার চেষ্টা করো, তাফসীর পড়ো, বেশি ফায়েদা হবে। এমন আরও নানা পরামর্শ আসতে থাকবে। এসবকে পেছনে ঠেলেই হিফযের দিকে পা বাড়াতে হবে।
৫৭. আমি কুরআন কারীম পড়তে শেখার সময়, হিফয করার সময়, যেসব ভুল করেছি, সেগুলো যতœ করে লিখে রাখা বা মনে রাখা। ওস্তাদজি আমার পড়া বা পড়ার পদ্ধতিতে যেসব ভুল ধরিয়ে দেন, সেগুলোও মাথায় রাখা। নিজে অন্যকে পড়ানোর সময় সেগুলো কাজে লাগবে।
৫৮. অভিজ্ঞ ওস্তাদের কাছে, একটা তাজবীদের কিতাব খুবই ভালো করে পড়ে নেয়া। মশক করে করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইলমে-আমলে অনেক বড় হলেও, কুরআন পড়া শুদ্ধ নয়, এমন মানুষও সমাজে দেখা যায়। পেছনে মুক্তাদি হলে, নামাজে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। অথচ দীর্ঘসময় লাগিয়ে মাদরাসায় পড়েছেন। অবশ্য এই চিত্র এখন কিছুটা বদলাচ্ছে।
৫৯. ছেলেকে ভর্তি করিয়ে, মাদরাসায় রেখে আসার সময়, আলিম বাবা পুত্রকে অশ্রুভেজা গলায় শেষ উপদেশ দিলেন, কোনো অবস্থাতেই কুরআন তিলাওয়াত ছাড়বে না। তুমি যত ইলম-কালামই শেখো, সবই কুরআনের জন্য। তুমি যতটুকু তিলাওয়াত করবে, অন্য ইলমে সে পরিমাণ বরকত তুমি আল্লাহর কাছ থেকে পাবে।
৬০. কিছু লোকের দৃষ্টিভঙ্গি কথাবার্তা শুনলে বেশ অবাক লাগে। তারা মুয়াল্লিমুল কুরআনকে সত্যিকারের মানুষ বলেই মনে করে না। তারা মনে করে, মুয়াল্লিমুল কুরআন সমাজের নিচুস্তরের লোক। সন্তানকে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি শিক্ষা দেয়ার জন্য টাকার মায়া করে না। টাকার যত মায়া মুয়াল্লিমুল কুরআনের বেলায়। দুনিয়ার পেছনে টাকা ঢালতে মন বাধে না, কুরআনের জন্য যাবতীয় অভাব-অনটনের ফিরিস্তি শুরু হয়ে যায়। সবারই জানা আছে, কুরআনের জন্য ব্যয় করা টাকার পুরোটাই আল্লাহর কাছে জমা থাকবে। তবুও দুনিয়া তাদের চোখে ঠুলি পরিয়ে রাখে।
৬১. কুরআন শিখতে গেলে, এমন শিক্ষকের কাছে যাওয়া, যার কাছে ইলমের আগে আমল শেখা যাবে। পেশাদার মুয়াল্লিমুল কুরআনের চেয়ে নেশাদার মুয়াল্লিমুল কুরআন বেছে নেয়া উত্তম। কুরআন কারীম যাদের নেশায় পরিণত হয়েছে, এমন শিক্ষক না পেলে অগত্যা পেশাদার মুয়াল্লিমুল কুরআনের দ্বারস্থ হতে হবে। নেশা ও পেশা একসাথে আছে, এমন শিক্ষক পেলে সোনায় সোহাগা।
৬২. আমি যত দক্ষ হাফেযই হই, আমার মধ্যে বিনয়ন¤্রতা না থাকলে, আমি ক্ষতির মধ্যে আছি। এমন হাফেযও দেখা যায়, তারা শুধুই কুরআনে হাফেয। অল্পবয়েসেই মিডিয়া-খ্যাতির পাল্লায় পড়ে, হিফযের পর আর পড়তে পারেননি। আল্লাহর ইচ্ছায় দেশে-বিদেশে ঘোরার কারণে টাকাপয়সা হয়েছে। এখন দেশের বড় আলিমকেও ছেড়ে কথা বলেন না। যথাযথ সম্মান বজায় রাখেন না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এমন বেয়াড়া আচরণ হাফেযে কুরআনের সাথে যায় না। গলা আর টাকার জোর স্থায়ী কোনো ‘অবলম্বন’ নয়। শুধু কুরআন মুখস্থ করলেই হবে না, কুরআনের শিক্ষা জীবনে ধারণ করা উচিত।
৬৩. দৈনিক হিযব নিয়মিত আদায় করার একটি উপায় হলো, হিযব আদায়কে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মতো আবশ্যকীয় অভ্যেসের মতো করে নেয়া। নামায ছুটে যাওয়ার কথা মনে হলে যেমন ভয় লাগে, হিযব ছুটে গেলেও যাতে সে-রকম ভয়ের অনুভূতি জেগে ওঠে। নামায আদায় না করলে যেমন অস্থির অস্থির লাগে, হিযব ছুটে গেলেও যেন সে রকম অস্থিরতা তৈরি হয়।
৬৪. হেফযখানার ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষকের সমালোচনা করার প্রবণতা কাজ করে। এই প্রবণতা সম্পূর্ণরূপে পরিহারযোগ্য। মা-বাবাকেও এ-ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। সন্তান যেন কিছুতেই ওস্তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ না করে। বেশির ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ওস্তাদ যৌক্তিক কারণে শাসন করলেও, দুষ্ট সঙ্গীদের পাল্লায় পড়ে, ভালো শিশুরাও ওস্তাদের সমালোচনায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। অভিভাবকদের এ-বিষয়টা খুবই গুরুত্বের সাথে খেয়াল রাখা জরুরি।
৬৫. হিফযের সবক শোনাতে গেলে, ভুল করলে ওস্তাদ অনেক সময় সবক না শুনে ফেরত পাঠিয়ে দেন। হেফযখানার পরিভাষায় বলা হয় ‘উঠিয়ে দেন’। একই সবকের জন্য বারবার উঠিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। ছাত্রকে এমন পরিস্থিতিতে মন খারাপ করতে নেই। ভেঙে পড়তে নেই। মা-বাবা আর ওস্তাদকেও ছাত্রের মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনায় রাখা জরুরি। ছাত্র যেন বিগড়ে না যায়। ছাত্রকে বলতে হবে, কুরআন শরীফ বারবার পড়তে পারা, আল্লাহর নেয়ামত। বাধ্য হয়ে পড়ার মানে এও হতে পারে, আল্লাহ তোমার পড়াটা বারবার শুনতে চাচ্ছেন। তাই সহজে সবকটা মুখস্থ হচ্ছে না। যতবার পড়ছ তোমার সওয়াব হচ্ছে। আল্লাহর দরবারে তোমার মর্যাদা বুলন্দ হচ্ছে।
৬৬. অতিব্যস্ত জীবনে দৈনিক হিযব আদায়ের জন্য একটানা লম্বা সময় পাওয়া না গেলেও সমস্যা নেই। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প অল্প করে হিযব আদায় করে নেয়া যেতে পারে। একবারে এক পৃষ্ঠা আধা পৃষ্ঠা করে পড়া সহজ। কাজের ফাঁকে সামান্য তিলাওয়াত কাজেও নতুন শক্তি উৎসাহ মনোযোগ এনে দেবে। কাজের অবসাদ দূর করতেও কুরআনি টনিক ব্যবহার করা যায়। প্রচ- কাজের চাপে, ত্রিশ সেকেন্ড বিরতি দিয়ে কুরআন কারীম খুলে একটা লাইন পড়ে নিতে পারি। এটা হতে পারে, গুমোট পরিবেশে বিশুদ্ধ বাতাস।
৬৭. শরীরের মতো আমার মাথা ও মনেরও বিশ্রাম প্রয়োজন। কুরআন তিলাওয়াতই হতে পারে সেই বিশ্রাম। হাঁটাচলায় কুরআন পড়তে পারি। হাঁটার কষ্ট অনেকটাই দূর হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা তৈরি হলে, মুসহাফ খুলে একটু কুরআন পড়ে নিতে পারি। কুরআনকে বানাতে হবে সার্বক্ষণিক সঙ্গী। একবারের বসায় বেশি পড়ার দরকার নেই। একটা আয়াত পড়েই মুসহাফ রেখে দিতে পারি। তবুও কুরআনের সাথে সংযোগ অটুট থাকুক।
৬৮. কারও কুরআন তিলাওয়াত শোনার সময়, ঘুণাক্ষরেও ভুল ধরার মানসিকতা মনে স্থান দেয়া যাবে না। ভুল ধরা পড়লে, আমি ‘পারি’, অন্যে ‘পারে না’ এই মনোভাবকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। এক ছোট্ট হাফেয তার ওস্তাদকে বলল, হুজুর আমি ওমুক বিখ্যাত কারীর পুরো কুরআন শুনে, সর্বমোট পাঁচটি ভুল ধরেছি। হুজুর উত্তর দিলেন, সুবহানাল্লাহ পুরো ত্রিশ পারায় মাত্র ‘পাঁচটি’? তাহলে তো তিনি বহু ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন।
বুদ্ধিমান ওস্তাদ ছাত্রের দৃষ্টিভঙ্গিকে সংশোধন করার চেষ্টা করেছেন। ছাত্রের ভুল প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেননি। কুরআনের সাথে কোনোভাবেই অহংকারকে মেশানো যাবে না। কুরআনের সাথে থাকতে হবে বিনয় নিয়ে।
৬৯. তৃতীয় হিজরীর বিখ্যাত বুযুর্গ, সাহল তুস্তরী রহ.। তাঁর এক ছাত্রের কাছে জানতে চাইলেন, কুরআন হিফয করেছ? জি না। সুবহা-নাল্লাহ! এ কেমন মুমিন, কুরআন হিফয করে না? তাহলে তুমি কী দিয়ে গুনগুন করবে? কী নিয়ে আনন্দ উদযাপন করবে? কী দিয়ে তোমার রবের সাথে কথা বলবে?
৭০. আল্লাহ তাওফীক দিলে কী না সম্ভব? ইমাম আল্লামা কাযি ইযযুদ্দীন বিন জামা‘আহ রহ.। ৮১৯ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। বেশি বয়েসে ইলম শেখা শুরু করেছিলেন। মাত্র এক মাসে পুরো কুরআন হেফয করে ফেলেছিলেন।
-বুগইয়াতুল উ‘আত, আল্লামা সুয়ূতী রহ.।
৭১. মুয়াল্লিমুল কুরআনের কী অপূর্ব সৌভাগ্য! প্রতিদিন তার কাছে কত ছাত্র কুরআন পড়তে আসে। ছাত্ররা হাজার হাজার হরফ তিলাওয়াত করে। সবগুলোর সওয়াব ওস্তাদের আমলনামায় লেখা হয়। মুয়াল্লিমুল কুরআনের এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?
৭২. তাজভীদ শেখার পর, প্রথম প্রথম কিছুদিন কুরআন তিলাওয়াত সাবলীল থাকে না। মুখে আটকায়। বারবার আটকাতে হয়। ইলমুল কেরাতে অভিজ্ঞ কোনো ওস্তাদের কাছে পড়তে গেলেও প্রথম প্রথম এত ভুল ধরা পড়ে, অনেক সময় মনে হয়, ইহজনমে বুঝি শুদ্ধ করে তিলাওয়াত করতে পারব না। ধৈর্য ধরে কয়েক দিন মশক চালিয়ে গেলে, আর সমস্যা থাকে না। সহজ হয়ে ওঠে। মুখের আড় ভাঙতে থাকে। তিলাওয়াতও সাবলীল ফুরফুরে হয়ে ওঠে। ওস্তাদের কাছে অনুশীলনের পাশাপাশি বেশি বেশি অভিজ্ঞ কারী সাহেবানের তিলাওয়াত শুনতে হবে। বেশি বেশি নিজে তিলাওয়াত করতে হবে।
৭৩. মুতাশাবিহাত আয়াত নিয়ে হাফেযদের অনেক ভুগতে হয়। পাকাপোক্ত ইয়াদ আর বেশি বেশি চর্চা ছাড়া, মুতাশাবিহাতের সমস্যা কাটিয়ে ওঠার ভিন্ন কোনো পথ নেই। বাজারে এ-বিষয়ে বহু কিতাব আছে। সেগুলোর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি, নিজেও মুতাশাবিহাতের খাতা বানিয়ে নিতে পারি। নিজে বানালে সুবিধা হলো, বিষয়টা বেশি চর্চা হয়। জেহেনে বসে। অন্য কিতাব সামনে রাখলে, চর্চা কিছুটা দুর্বল হয়ে যায়।
৭৪. হাফেযে কুরআন বড় আলেম হয়ে গেলেও, ছোটবেলার হিফযের শিক্ষককে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। নূরানী-হিফয বিভাগের ওস্তাদকে সব সময় আদর-যতœ, আদব-ইহতিরাম করে যাওয়া জরুরি। তারা আমার ভিত গড়ে দিয়েছেন। প্রতিটি দোয়ায় তাদের কথা স্মরণ রাখা জরুরি। তারা আমার মাতা-পিতার মতোই। আমার পেছনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।
৭৫. বড় ও বিখ্যাত ওস্তাদের কাছে যেতে অনেক সময় ভয় কাজ করে। তারা আমার মতো ছোট ছাত্রকে গ্রহণ করবেন কি না, এ-নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়। সংকোচের কারণে তাদের কাছ থেকে কিছু শেখা হয়ে ওঠে না। সংকোচ ঝেড়ে ফেলে, সরাসরি তাদের দরবারে হাজির হয়ে যাওয়া উচিত। বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায়, আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক। কাক্সিক্ষত ব্যক্তিটি খুবই বিনয়ী। ছাত্রবৎসল। কুরআনি ইলমের জন্য মনে কোনো ভয় বা জড়তা রাখা উচিত নয়। কুরআনি ইলমের জন্য মরিয়া হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
৭৬. মুয়াল্লিমুল কুরআনের দায়িত্ব, জরুরি ভিত্তিতে একটি কাজ নিয়মিত করা। শিষ্যদের সামনে কুরআন-বিষয়ক আয়াতগুলো নিয়মিত তুলে ধরা। আয়াতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তাদের মনে গেঁথে দেয়া। বিশেষ করে এই আয়াত,
وَمَنۡ أَعۡرَضَ عَن ذِكۡرِی فَإِنَّ لَهُۥ مَعِیشَةً ضَنكًا وَنَحۡشُرُهُۥ یَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِ أَعۡمَىٰ قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرۡتَنِیۤ أَعۡمَىٰ وَقَدۡ كُنتُ بَصِیرًا قَالَ كَذَ ٰلِكَ أَتَتۡكَ ءَایَـٰتُنَا فَنَسِیتَهَاۖ وَكَذَ ٰلِكَ ٱلۡیَوۡمَ تُنسَىٰ
আর যে আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন হবে বড় সংকটময়। আর কিয়ামতের দিন দিন আমি তাকে অন্ধ করে উঠাব। সে বলবে, হে রব্ব, তুমি আমাকে অন্ধ করে উঠালে কেন? আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম! আল্লাহ বলবেন, এভাবেই তোমার কাছে আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। আজ সেভাবেই তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে (ত্বহা, ১২৪-১২৬)।
৭৭. হিফযখানায় ওস্তাদজি কুরআনের আয়াত দিয়েই শিষ্যদের উপদেশ দেবেন। পঠিত আয়াত সাধ্যমতো নিজের ভাষায় বুঝিয়ে দেবেন, তাদের যেকোনো সমস্যার সমাধান কুরআন থেকে দেয়ার চেষ্টা করবেন। অন্তত সরাসরি প্রাসঙ্গিক না হলেও, ধারেকাছের অন্তত একটি আয়াত পাঠ করবেন।
৭৮. কুরআন কারীম হিফয অনেকেই করতে পারে। কিন্তু অল্পসংখ্যক মানুষ আছে, যারা আল্লাহর প্রতি নতজানু হয়ে, সমর্পিত চিত্তে, বিনয়ন¤্রতার মনোভাব নিয়ে হিফয করে। প্রতিটি সূরা শুরুর আগে, প্রতিদিন নতুন হিফয করতে বসার আগে, নিজের সবকিছু আল্লাহর কাছে সোপর্দ করা উচিত। নিছক নিজের মেধামেহনতের ওপর আত্মবিশ^াস রেখে আল্লাহর ভূমিকাকে গৌণ করে ফেলা মুমিনের কাজ নয়। হিফয করার সময়, প্রতিটি মুহূর্তে মনে রাখা দরকার, আমার কোনো শক্তি নেই, একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ আর তাওফীকের বদৌলতেই আমি হিফয করতে সমর্থ হব। একজন সুদক্ষ হাফেয হতে গেলে, সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার ওপর তাওয়াক্কুলের কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহর মহা কুদরতের কাছে নিজের দুর্বলতা অসহায়ত্ব স্বীকার করা ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নেই।
৭৯. কুরআনে হাফেযের উচিত, নিজের নেক আমলের কথা মনে না রাখা। যথাসম্ভব নিজের নেককাজগুলো ভুলে থাকা নিরাপদ। নিজের নেক আমলকে যথেষ্ট বা পর্যাপ্ত মনে করার মানসিকতা থাকলে, পরিহার করা জরুরি। পাশাপাশি পুরো কুরআন হিফয হয়েছে বা এত এত পারা হিফয হয়েছে, এটা নিয়ে মনের মধ্যে গরম ভাব রাখাও বিপজ্জনক। এমন মানসিকতা থেকে অহংকার জন্মায়। আল্লাহ তা‘আলা অহংকারী থেকে নেয়ামত ছিনিয়ে নেন। আল্লাহ না করুন, কুরআনের হিফয ছিনিয়ে নিলে, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর হতে পারে না।
৮০. কুরআনের প্রতি উদাসীন বা কুরআন হিফযের প্রতি আগ্রহী নয়, এমন কাউকে কুরআনের প্রতি আগ্রহী করে তোলার কার্যকর একটি উপায় হচ্ছে, নিজের হিফয করা অংশ থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে তাকে শোনানো। সে কুরআন খুলে পড়া ধরবে। ভুল হলে বলে দেবে। নিয়মিত কিছুদিন কাজটা চালিয়ে যেতে হবে। ইন শা আল্লাহ কুরআনের প্রতি তার আগ্রহ বাড়বেই।
৮১. ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কুরআন হিফযে কোনো টাকা খরচা নেই। কুরআন হিফয়ে সময়ের অপচয় হওয়ার ভয় নেই। পৃথিবীর যাবতীয় শাস্ত্র মুখস্থ করলে, তার সবটা কাজে না লাগারও সম্ভাবনা থাকে। একমাত্র কুরআন কারীম ব্যতিক্রম। যতটা মুখস্থ করব, তার পুরোটাই কাজে লাগবে। এখানে দুনিয়াতে, ওখানে আখেরাতেও। কুরআন হিফযের পেছনে সময় ব্যয় করলে, আমার অন্য কাজে ব্যাঘাত ঘটবে, এমনটা ভাবা উচিত নয়। আমি মুসলিম হলে, আমার জীবন-মরণ, সময়মেধাশ্রম সবই তো কুরআনের তরে হওয়া উচিত ছিল। কুরআনের সাথে সময় কাটানোকে জীবনের জন্য, রুজি-রোজগারের জন্য ক্ষতিকর ভাবছি কী করে? কুরআন কি নিজেই ‘মুবারক’ নয়? বরকতময় নয়? এ তো আল্লাহ তা‘আলারই স্বীকৃতি।
৮২. প্রতিজ্ঞা করার পরও দৈনিক হিযব আদায় করা হয়ে উঠছে না? বারবার চেষ্টা করার পরও ব্যর্থ হচ্ছি? আমাকে দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখতে হবে। ভালো করে পরীক্ষা করতে হবে, আমি কোনো গুনাহে লিপ্ত আছি কি না। আমি এমন কোনো কাজ করছি কি না, যা অজান্তেই আমাকে কুরআন থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। এমন কোনো বই পড়ছি কি না, যার বিষয়বস্তু মনে ‘অন্ধকার’ সৃষ্টি করে। মোবাইল/টিভি/ল্যাপটপে এমন কিছু দেখছি কি না, যা দুনিয়া-আখেরাতে কোনো কাজেই আসে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন কারও সাথে যুক্ত কি না, যার সাথে যোগাযোগ রাখা সম্পূর্ণ হারাম। এমন কোনো বন্ধু আছে কি না, যার সাথে ওঠাবসা করলে আখেরাতের চেয়ে দুনিয়ার দিকে মন বেশি ঝুঁকে পড়ে? এমন কোনো আড্ডায় বসি কি না, যেখানে শুধু দুনিয়া আর দুনিয়া নিয়েই কাজকারবার হয়? আমার পাতে যে খাবার উঠছে, সেখানে সুদঘুষজুলমের চিহ্ন নেই তো? নামাযের সময় এসে চলে যাচ্ছে দেখেও দুনিয়াবি কাজে মশগুল থাকছি না তো? এসব ঠিক থাকলে, দৈনিক হিযব এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে।
৮৩. কুরআন হিফয করলে দুনিয়ার বড় কোনো পদমদ লাভ হবে না। কুরআন হিফয আমাকে হয়তো দুনিয়াবি প্রাপ্তি জুটিয়ে দেবে না। তবে, কুরআন হিফয আমাকে আল্লাহর রহমত এনে দেবে। আমাকে আল্লাহর খাস আর বিশেষ বান্দায় পরিণত করবে। আমাকে বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করবে। আমাকে আত্মিক রোগব্যাধি থেকে পবিত্র রাখবে। আমাকে ভ্রান্তি থেকে রক্ষা করবে। আমাকে সঠিক-সরল পথে পরিচালিত করবে। আমাকে শুধু হিফযের পাশাপাশি একটু একটু করে বোঝার চেষ্টাও করতে হবে।
৮৪. আমাকে আগে ঠিক করতে হবে, কুরআন কারীম আমার কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কি না। এটা নির্ধারিত হলে, অনেক প্রশ্নের উত্তর এমনি এমনি স্পষ্ট হয়ে যাবে। কুরআন কারীম আমার কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হলে, দৈনিক হিযব আদায়ে ব্যস্ততার অজুহাত থাকবে না। কারণ, তখন যত ব্যস্ততাই থাকুক, সব কুরআনের নিচে।
৮৫. দৈনিক হিযব আদায়ের অন্যতম উপকারিতা হলো, কলবকে প্রশান্ত করে তোলে। মনের অস্থিরতা দূর করে। মনের আঁধারকে আলোয় ভরিয়ে তোলে। ভেতরের পাপকে পুণ্যে রূপান্তরিত করে। নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গপূর্ণ করে তোলে। সর্বোপরি জীবনকে বরকতময় করে তোলে।
যেমনটা কুরআনে আছে (كِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ إِلَیۡكَ مُبَـٰرَكٌ)এটি এক বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি (সোয়াদ, ২৯)।
৮৬. তিলাওয়াতের আগে ও পরে, হিফযকারী ও দৈনিক হিযব আদায়কারীর কিছু অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।
১. তিলাওয়াত শুরুর আগে, নিয়ত দুরুস্ত করে নেয়া। ইখলাস বিশুদ্ধ করে নেয়া। ইখলাস মানে, শুধু আল্লাহর জন্যই কোনো আমল করা। আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করা। আল্লাহর কাছে নিজের অক্ষমতা দুর্বলতা তুলে ধরা। নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে সাহায্য প্রার্থনা করা।
২. তিলাওয়াত শুরুর আগে বেশি বেশি ইস্তেগফার করা। মনকে আল্লাহমুখী করে তাওফীক চেয়ে দোয়া করা। এতে তিলাওয়াত সহজ হয়ে উঠবে। হিফয করলে দ্রুত মুখস্থ হবে। ইন শা আল্লাহ।
৩. যদ্দূর হিফয হয়েছে, সেটাকে সলাতে পড়ার চেষ্টা করা। আগে যা হিফয হয়েছে, যতটুকু সম্ভব সেটাও সলাতে তিলাওয়াতের চেষ্টা করা।
৪. গুনাহ থাকলে, হিফয থাকে না। তাই গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। নজরের হেফাজত করা। জবানের হেফাযত করা। অনর্থক কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা।
তিলাওয়াত-পরবর্তী কিছু করণীয়,
১. নির্দিষ্ট পরিমাণ হিফয ও তিলাওয়াত শেষে আল্লাহর হামদ ও সানা পাঠ করা। অন্তর থেকে আল্লাহর শোকর আদায় করা। তিনি তাওফীক দিয়েছেন, এ জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ গদগদ থাকা।
২. তিলাওয়াতের সময় যেসব আয়াত ভাবিয়ে তুলেছিল, সেসব আয়াত আবার ভাবনায় আনা। সম্ভব হলে ভাবনাগুলো লিখে রাখা বা অন্য কারও সাথে কথা বলে নেয়া।
৩. আগ্রহের শেষসীমা পর্যন্ত তিলাওয়াত না করা। আগ্রহ একটু বাকি রেখেই তিলাওয়াত শেষ করা।
৪. যা তিলাওয়াত করেছি, যা হিফয করেছি, সেটা আমলে আছে কি না, যাচাই করে দেখা। আমল না থাকলে ইলমে বরকত থাকে না।
৮৭. দৈনিক হিযব আদায় করতে পারছি, প্রতিদিন কিছু কিছু হিফয করতে পারছি, এ জন্য আল্লাহর প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকা। উঠতে বসতে এ জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। ইলমের পূর্ণতা আমল ও শোকরে। ইলমে বরকত আসে আমল আর শোকরের দ্বারা,
لَىِٕن شَكَرۡتُمۡ لَأَزِیدَنَّكُمۡۖ
তোমরা সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আমি তোমাদের আরও বেশি দেবো (ইবরাহীম ৭)।
৮৮. আমি কি কুরআনে হাফেয? হাফেয না হলেও, আমার কি সাধারণের তুলনায় একটু বেশি কুরআন মুখস্থ আছে? আমি কি আমার মুখস্থ থাকা সূরা বা আয়াতগুলো নিয়মিত নামাজে তিলাওয়াত করি? কেন করি না? নামাজে পড়ার মতো মুখস্থ নেই বলে? নামাজেই যদি তিলাওয়াত না করলাম, তাহলে এই মুখস্থের কী দাম রইল?
৮৯. ছোট ছোট সূরা দিয়ে নামাজ পড়ার বাইরে গিয়ে, তিলাওয়াত করাকে কঠিন কাজ মনে হয়? এটা ভুল ধারণা। কাজটা মোটেও কঠিন নয়। প্রয়োজন সদিচ্ছার। আমাকে প্রথমে ঠিক করতে হবে, কোন কোন সূরা বেশি ইয়াদ আছে। প্রথমে সেগুলো দিয়ে শুরু করতে হবে। হিম্মত না হলে, নামাজে দাঁড়ানোর আগে কাক্সিক্ষত সূরাটা বারবার ইয়াদ করে নিতে হবে। পরিমাণ অল্প করে হলেও কাজটা শুরু হোক। কাজটা কঠিন মনে হলেও, মোটেও কঠিন নয়। আস্তে আস্তে পুরো কুরআনকে নামাজের তিলাওয়াতে নিয়ে আসতে হবে। তাহাজ্জুদে, আগে-পরের সুন্নত নফলে। ইন শা আল্লাহ।
৯০. কুরআন হিফযের সময় একটা ভুল প্রায় সবাই করে, প্রতিদিন নতুন আয়াত হিফযের প্রবল আগ্রহে পুরোনো হিফযের কথা ভুলে যায়। নতুনের মতোই পুরোনো হিফযকে গুরুত্ব দিয়ে পড়তে হবে।
৯১. আল্লাহর অশেষ রহমত, তিনি আমাদের এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন। হায়াত আর কতটুকু বাকি আছে, সেটা আমরা কেউ জানি না। আমি চাইলে কুরআনের হাফেয হয়ে কেয়ামতের ময়দানে হাজির হতে পারি। এখনই প্রতিজ্ঞা করে হিফয শুরু করে দিতে পারি। শেষ করতে পারি আর না পারি, হিফয-প্রত্যাশীদের তালিকায় তো একবার নাম উঠিয়েছি। শেষবিচারের দিন এই তালিকায় নাম থাকাও নাজাতের উসীলা বনে যেতে পারে। আর দেরি কেন?
৯২. কুরআন কারীম হিফয করতে পারা আল্লাহর দেয়া এক বড় নেয়ামত। আমি কুরআনকে সীনায় সংরক্ষণ করলে, কুরআনও আমাকে নিচু অনৈতিক কাজ থেকে রক্ষা করবে। অনর্থক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়া থেকে রক্ষা করবে। মিথ্যা-ভ্রান্ত চিন্তা থেকে রক্ষা করবে। অনৈতিক অশ্লীল আচরণ থেকে রক্ষা করবে। আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুনাহ থেকে রক্ষা করবে। কুরআন হিফয আমাকে আকাশের উচ্চতায় উন্নীত করবে।
৯৩. ভালো হাফেয হতে পারলে, ভালো কারী হতে পারলে, অনেক সময় মনে অহংকার জন্মায়। তখন তিলাওয়াতে রিয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আমি কীভাবে বুঝব আমার কুরআনি মেহনতে রিয়ার সংমিশ্রণ আছে কি না?
আমি অন্যকে তিলাওয়াত শোনানোর সময়, অন্যকে নিজের কুরআন-বিষয়ক যোগ্যতার কথা বলার সময়, যদি তাকে মুগ্ধ করা, নিজের কৃতিত্ব জাহির করা হয়, তাহলে এটা রিয়া। আর যদি সওয়াবের আশায় হয়, অন্যকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য হয়, এটা ইবাদত। আশা করা যায়, আল্লাহ কবুল করবেন।
৯৪. যখন আমি আত্মমুগ্ধ হয়ে তিলাওয়াত করি, অন্যদের চেয়ে নিজেকে সেরা শ্রেষ্ঠ মনে করে, অন্যদের মুগ্ধদৃষ্টি আর প্রশংসা লাভ করতে চাই—আমি রিয়াকারী। যখন আমি অন্যদের কুরআনের নূর বিতরণের উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করি, অন্যদের আনন্দ দেয়ার জন্য তিলাওয়াত করি, অন্যদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিলাওয়াত করি—আমি ইবাদতকারী। ইন শা আল্লাহ।
৯৫. বড় হয়ে হিফয শুরু করলে, প্রথম দিকে যাকে-তাকে বলে বেড়ানো ঠিক নয়। অনেক সময় মুখদোষ লাগে বা নেতিবাচক মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়। যাদের কাছে দোয়া পাওয়া যাবে, উৎসাহ প্রেরণা পাওয়া যাবে, তাদের বলা যেতে পারে। তবে যতটা সম্ভব গোপন রাখাই নিরাপদ। হিফযের শুরুতে নিজের ‘ইখলাস’ ঠিক করে নেয়া। বারবার যাচাই করে নেয়া, আমি আল্লাহর জন্যই হিফয করছি তো? অনেক সময় হিফযের শুরুতেই ইখলাস দুর্বল হয়ে যায়। হিফয শুরু করার পর, অন্যদের বলার জন্য মন নিশপিশ করতে থাকে। কেউ গান শিখলে, সুযোগ পেলেই সেটা অন্যদের শুনিয়ে মুগ্ধদৃষ্টি দেখতে চায়। কুরআন যেন গানের মতো হয়ে না যায়।
৯৬. কুরআন কারীম হিফয করতে পারা, আল্লাহর অনেক বড় অনুগ্রহ। এই নেয়ামত পেয়ে আনন্দিত হওয়াও ইবাদত। কিন্তু আনন্দ যেন রিয়া আর তাকাব্বুর হয়ে না যায়, সেদিকে সতর্কদৃষ্টি রাখা জরুরি। শয়তান সব সময় ওত পেতে আছে। তবে জোর করে গোপন করাও ঠিক নয়, যার-তার কাছে প্রকাশ করাও ঠিক নয়। স্বাভাবিকভাবে আপন কাজ করে যাওয়াই ভালো। শুধু খেয়াল রাখা, ইখলাস ঠিক আছে কি না। নিয়মিত আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে দোয়া করে গেলে, আল্লাহর কাছে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় চাইতে থাকলে, লোকে জানলেও সমস্যা নেই। শয়তানও সুবিধা করতে পারবে না। আল্লাহই রক্ষা করবেন।
৯৭. দৈনিক হিযব আমার জন্য নেয়ামত। আমার ওপর বোঝা নয়। নিয়মিত আমার নিয়তের অবস্থা যাচাই করে নেব। আমি কেন হিযব আদায় করি? এই প্রশ্নের উত্তর সব সময় মনে হাজির রাখলে, হিযববিরোধী অনেক সমস্যা এমনি এমনি সমাধান হয়ে যাবে। অনীহা নিয়ে হিযব আদায়ে উপকার কম। কুরআন বড় আত্মমর্যাদাবোধ-সম্পন্ন কিতাব। উদাসীন কলবে কুরআন বসে না। ধীরস্থির তিলাওয়াত, বিনয়ন¤্র সুর কুরআনকে কাছে টানে।
৯৮. তিলাওয়াতের আগে, আমার মনে বসিয়ে নিতে হবে, আমি সাধারণ কোনো গ্রন্থ পাঠ করতে যাচ্ছি না। আমি মহান রাব্বুল আলামীনের কালাম তিলাওয়াত করতে যাচ্ছি। আল্লাহর কুদরত, আল্লাহর বড়ত্ব, আল্লাহর শক্তি উপলব্ধিতে জাগরূক রেখে তিলাওয়াত শুরু করতে হবে। একটু পরপর মনে হাজির করতে হবে, তিলাওয়াতকালে আমি প্রতিনিয়ত রহমত নূর হেদায়াত শিফা লাভ করছি।
৯৯. দৈনিক হিযব আদায়ের অন্যতম একটি উপকার হলো, আমি অনুভব করেছি, দীর্ঘদিন ধরে আমার মধ্যে থাকা কিছু বদভ্যেস, যেগুলো আমি শতচেষ্টা করেও দূর করতে পারছিলাম না, দৈনিক হিযব শুরু করার পর, আলহামদুলিল্লাহ সেগুলো সহজেই দূর হয়ে গেছে। দৈনিক হিযব আদায়ে নিজেকে সহজেই ভালোর দিকে পরিচালিত করা যায়। নিজেকে অনায়াসে নেক আমলের দিকে বাড়ানো যায়। নিজের মধ্যে থাকা নানাবিধ সমস্যা দূর হতে শুরু করে।
১০০. আমি অটল-অচল প্রতিজ্ঞা করে নিই, যেকোনো মূল্যে ফজরের পরপরই দৈনিক হিযব আদায় করে ফেলব। এই সময়ে বেশি বরকত পাওয়া যায়। এই সময়ের তিলাওয়াতের প্রভাবও মনের ওপর বেশি পড়ে। শেষ-রাতে আদায় করতে পারলে আরও উত্তম। একান্ত অপারগ হলে, এই দুই সময় ছাড়া অন্য সময় হিযব আদায় করা যেতে পারে।
১০১. কুরআন হিফযের দশ সূত্র :
১. নিয়ত সহীহ করা। নিয়তে ইখলাস আনা। শুধুই আল্লাহর জন্য হিফয করছি। একমাত্র আল্লাহকে রাজিখুশি করার জন্য হিফয করছি।
২. আল্লাহর কাছে ইস্তে‘আনত-সাহায্য চাওয়া।
৩. কাকুতিমিনতি করে আল্লাহর কাছে তাওফীক কামনা করে দোয়া করা।
৪. যেটুকু হিফয করব, একজন অভিজ্ঞ শায়খের কাছ থেকে শুনে নেয়া।
৫. সরাসরি কুরআন হাতে নিয়ে বারবার তাকরার আওড়ানো। দোহরানো। রিপিট করা। পুনরাবৃত্তি করা।
৬. কুরআন বন্ধ করে বারবার তাকরার করা।
৭. তাহাজ্জুদে-নফলে-সুন্নতে পড়া।
৮. নতুন পড়ার সাথে সাথে পেছনের পড়া নিয়মিত ইস্তেহযার—নতুন করে যাচাই করে দেখা।
৯. আয়াতের তরজমা-তফসীর দেখে নেয়া।
১০. আয়াতকে আমলে পরিণত করা।
১০২. আমি কুরআন কারীমের একটি আয়াত হেফয করতে পারলে, একটি আয়াতের তরজমা-তাফসীর বুঝতে পারলে, এর কৃতিত্ব কখনো কিছুতেই নিজের দিকে টেনে নেব না। আমার ছোট থেকে ছোট অর্জনও আল্লাহর অপার কৃপা ও অশেষ অনুগ্রহেই অর্জিত হয়েছে, এই মনোভাব সব সময় মনে হাযির-নাযির রাখা। ছোট অর্জনের জন্যও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়া।
১০৩. জাগ্রত হৃদয়ে দৈনিক ‘বিরদ’ আদায় করলে, আমার মধ্যে পরিবর্তন আসবেই। নিয়মিত ‘হিযব’ আদায় আমাকে হকের পথে অটল-অবিচল রাখবে। মাথার ওপর দুঃখ-দুশ্চিন্তার পাহাড় জমে থাকলেও, দৈনিক বিরদ সবকিছু দূর করে দেবে। অনেক চিন্তা ও বিশ্বাস এমন আছে, যেগুলো বাস্তবে ভ্রান্ত হলেও, সেগুলোর ভ্রান্তি আমার কাছে পরিষ্কার নয়, দৈনিক হিযব আদায়, আমার মাথা থেকে এসব ভ্রান্ত চিন্তাগুলো দূর করে দেবে। চিন্তাগুলোর ভ্রান্তি আমার কাছে পরিষ্কার করে দেবে। কিছু ভ্রান্তি থাকে, পরিবার-পরিবেশ থেকে আসে। জন্ম থেকেই এসব ভ্রান্ত আচার দেখে দেখে বড় হয়। এসব ভ্রান্ত চিন্তা-আচারকে সঠিক অভ্রান্ত মনে করেই বড় হয়। এমন শেকড় গেড়ে বসা ভ্রান্তিও নিয়মিত আন্তরিক হিযব আদায়ে দূর হয়ে যায়। ইন শা আল্লাহ।
১০৪. আমাকে দৃঢ়সংকল্প করে নিতে হবে, ফজরের আগে বা পরেই দৈনিক হিযব/বিরদ আদায় করে ফেলব। এই সময় তিলাওয়াতের অন্যরকম এক শক্তি থাকে। আগের হিফয ধরে রাখার জন্যও এই সময়ের তিলাওয়াত বেশি উপকারী। অভিজ্ঞজনের পরামর্শও এমন।
১০৫. দৈনিক হিযব আদায়ের অপূর্ব এক প্রভাব লক্ষ করেছি আমার জীবনে। কুরআনি হিযবের প্রভাবে আমার চারপাশের সবকিছু সহজ হয়ে যায়। প্রতিটি কাজে পদক্ষেপে আল্লাহর অনুগ্রহ আর করুণা অনুভব করি। নিয়মিত হিযবের প্রভাব অনেক বদ্ধ দুয়ারও সহজে খুলে যেতে দেখেছি। দৈনিক বিরদের বরকতী ছোঁয়ায় আমল-আখলাকেও উন্নতি দেখেছি। ফরয-নফল ইবাদতে উৎসাহ-উদ্দীপনা অনুভব করেছি। কুরআনের প্রভাবে কেমন যেন মনে হয়, আমার অদৃশ্য কিছু সহযোগী সেবক খাদেম আছে। তারা অগোচরে আমার কাজগুলো এগিয়ে রাখে। মানুষ যদি জানত, কুরআনের সাথে লেগে থাকার কী বরকত আর হাকীকত, তাহলে কুরআন ছেড়ে উঠতেই চাইত না। দৈনিক হিযব/বিরদের পরিমাণ দিন দিন বাড়িয়েই চলত। — নুসাইবা ঈমান (কায়রোয়ান)।
১০৬. দৈনিক হিযবের পরিমাণ একেকজনের একেকরকম। হাফেয আর অ-হাফেযের দৈনিক হিযবের পরিমাণে তারতম্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। সব হাফেয মুখস্থ তিলাওয়াত করতে পারেন না। দশ দিনে খতম করলে দৈনিক হিযব হবে তিন পারা। পনেরো দিনে খতম হলে, দৈনিক দুই পারা। তবে ২৯-দিনে মাস ধরাই নিরাপদ। তাহলে মাসটা কয়দিনের হবে, সেটা নিয়ে বাড়তি ভাবনা করতে হয় না।
১০৭. নিয়মিত হিযব আদায় শুরু করলে, প্রথম প্রথম বাহ্যিকভাবে এর প্রভাব চোখে পড়ে না। কিছুদিন যাওয়ার পর দৈনিক হিযবের প্রভাব পরিস্ফুট হতে শুরু করে। প্রথম কিছুদিন চলে যায়, মনকে পোষ মানাতে। কলবকে পরিষ্কার করতে। একটা আয়না দীর্ঘদিন মাটিতে পড়ে থাকলে, মাটি থেকে তুলেই চেহারা দেখা যায় না। ভালো করে মুছতে হয়, পালিশ করতে হয়। হিযবের প্রথম দিকটাও এমন। কিছুদিন কলবের মরিচা ঘষে সাফ করতে হয়। দীর্ঘদিন শুকনো পড়ে থাকা চৌবাচ্চা পানিভর্তি করতে গেলে, প্রথমে ঢালা পানিগুলো দেখা যায় না। শুকিয়ে থাকা মাটির দেয়াল, পানিগুলো শুষে নেয়। পরে আস্তে আস্তে পানি জমতে শুরু করে। দৈনিক হিযবও এমন। শুরুর দিকের তিলাওয়াত, কলবে লেগে থাকা গুনাহের কালিমা, নিফাক, প্রবৃত্তি, ভ্রান্ত চিন্তা সাফসুতরো করে তোলে। তারপর কলবকে কুরআনি নূরে সাজাতে শুরু করে। কলবের নূর আস্তে আস্তে বাইরে উপচে পড়তে শুরু করে। নিয়মিত হিযব আদায়কারীর আশেপাশের মানুষও তার কুরআনি বারাকাহ লাভ করে।
১০৮. আমরা যারা কুরআন কারীম বুঝি না, তারা শুরুতে না বুঝে দৈনিক হিযব আদায় করলেও, কিছুদিন যাওয়ার পর, কলব নিয়মিত হিযব আদায়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে, কুরআন কারীম অল্প অল্প বোঝার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। নইলে হিযব আদায়ও একসময় দরবেশদের তাসবীহ টিপে যিকিরের মতো হয়ে যাবে। না বুঝে তিলাওয়াত করলেও উপকার আছে। তবে সামর্থ্য থাকলে, কেন বোঝার চেষ্টা করব না?
১০৯. নিয়মিত হিযব আদায়ে, অজান্তেই কলবের অনেক রোগ সেরে যায়। হিযব আদায়কারীও টের পায় না। অনেকের কলবে দীর্ঘদিনের দুরারোগ্য নানাবিধ মানসিক ব্যাধি বাসা বেঁধে থাকে। কুরআন আস্তে আস্তে এসব ব্যাধি থেকে কলবকে মুক্ত করতে শুরু করে। কলব পুরোপুরি সাফসুতরো হলে, পরের ধাপে কলবকে ওহীর নূর দ্বারা পূর্ণ করতে শুরু করে। ওহীর নূর যখন কলব ছাপিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, বান্দা পরিপূর্ণ আরোগ্য লাভ করে।
১১০. কুরআন হিফযের জন্য উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় বসে থাকা চরম ভুল চিন্তা। হিফয শুরু করার সময় এখনই। এই মুহূর্তেই। কখন সময় আসবে, কখন শরীর সুস্থ হবে, কখন ব্যস্ততা কমবে, এটার কোনো ঠিক আছে? এর আগে মরে গেলে? একলাইন হলে একলাইন করে হলেও, হিফয শুরুর সময় এখনই।
১১১. আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দৈনিক হিযব প্রতিদিন তিনপারা করে হওয়া দরকার। একপারা তো অবশ্যই। প্রথম প্রথম কষ্ট হবে। একনাগাড়ে চেষ্টা চালিয়ে গেলে, দৈনিক হিযব তিনপারায় উন্নীত করা সম্ভব। কুরআন আমাকে যা দিবে, পৃথিবীর অন্য কিছু আমাকে তা দিতে পারবে না। তাহলে কেন আমি কুরআনের সাথে সময় কাটাতে দ্বিধান্বিত থাকব?
১১২. ১৮৫ জন বন্দীর মধ্যে একটা জরিপ চালানো হয়েছিল। তাদের শর্ত দেয়া হয়েছিল, কুরআন হেফয করতে পারলে মুক্তি দেয়া হবে। সাধারণভাবে সাজা ভোগ করে যেসব অপরাধী মুক্তি পেয়েছিল, তাদের অনেকেই পুরনায় কারাগারে এসেছে। আবার কোনো অপরাধ করে। কিন্তু হিফযের শর্ত পূরণ করে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের পুনরায় অপরাধ করে জেলে আসার হার ছিল শতকরা ০%।
১১৩. যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, নামায আদায় করে এবং আমি তাদের যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (সৎকাজে) ব্যয় করে গোপনে ও প্রকাশ্যে, তারা এমন ব্যবসায়ের আশাবাদী, যাতে কখনো লোকসান হয় না (ফাতির, ২৯)।
إِنَّ ٱلَّذِینَ یَتۡلُونَ كِتَـٰبَ ٱللَّهِ وَأَقَامُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنفَقُوا۟ مِمَّا رَزَقۡنَـٰهُمۡ سِرًّا وَعَلَانِیَةࣰ یَرۡجُونَ تِجَـٰرَةً لَّن تَبُورَ
আল্লাহর কিতাব পাঠ করা লাভজনক ব্যবসা।
১১৪. আমি হাফেয হব, কারণ :
১. কুরআনের হাফেয হতে পারা অনেক বড় নেয়ামত। প্রতিটি মুসলমানের এই নেয়ামত লাভের জন্য লালায়িত হওয়া জরুরি। মাদরাসায় পড়িনি, বয়েস বেড়ে গেছে, ব্যস্ততার জন্য সময় নেই, এসব খুবই ঠুনকো অজুহাত। সব অজুহাত ছেড়ে হিফয শুরু করে দিতে পারি।
২. আমার দায়িত্ব তাওয়াক্কুল করে শুরু করে দেয়া। দিনে এক আয়াত বা আধা আয়াত? নিদেনপক্ষে তিন দিনেও এক আয়াত? অসম্ভব কিছু? শুরু না করার যুক্তিসংগত কোনো অজুহাত আছে?
৩. ইমাম যুফার বিন হুযাইল রহ.। ইমাম আযম আবু হানীফা রহ.-এর অন্যতম শাগরিদ। তিনি একটু বেশি বয়েসেই ইমাম আযমের দরবারে এসেছিলেন। পড়াশোনাও দেরি করে শুরু করেছিলেন। প্রথম জীবনে হাফেয হতে পারেননি। জীবনের শেষ দুই বছরে, অন্য সব কাজে সময় কমিয়ে, হিফযুল কুরআনে মনোনিবেশ করেছিলেন।
৪. আল্লাহর অপূর্ব মহিমা। হিফয শেষ হওয়ার কিছুদিন পরই মারা গেলেন। মৃত্যুর পর এক পরিচিতজন তাকে স্বপ্নে দেখলেন। অবস্থা জানতে চাইলেন। ইমাম যুফার রহ. বললেন,
-শেষের দুই বছরের জন্য রাব্বে কারীম মাফ করে দিয়েছেন। শেষ দুই বছরের হিফযুল কুরআনের আমল না থাকলে, যুফার ধ্বংসই হয়ে গিয়েছিল! (শরহু মুসনাদি আবি হানীফা, ১/৪৫)
৫. চাকরির ফাঁকে ফাঁকে, গার্হস্থ্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে, হিফযুল কুরআন চলতে পারে। এখন তো কত সহজ। কত কত অ্যাপ। একটি আয়াতকে বারবার পড়ে শোনায়। প্রতিটি শব্দকে ভেঙে ভেঙে পড়ে শোনায়।
৬. কুরআন পড়তে পারি না, কুরআন শুদ্ধ নেই, এসব অজুহাত ধোপে টিকবে? প্লে-স্টোরে হিফয সহায়ক কত কত অ্যাপ ছড়িয়ে আছে! কুরআন একদম পড়তে না জানলেও আজকাল হাফেয হওয়া খুবই সহজ। অন্ধরা শুনে শুনে হাফেয হচ্ছে না?
৭. রাব্বে কারীমের ওপর তাওয়াক্কুল করে শুরু করে দিতে পারি না? ইন শা আল্লাহ। রাব্বে কারীম তাওফীক দান করুন। আমীন।
.
এই লেখার পাশাপাশি ‘হিযবী মিনাল কুরআন’ লেখাটিও পড়তে পারি।