December 6, 2021

Compilation of Atik Ullah Posts

□□এক ইয়ামানি পিতা সন্তানদের জন্যে ঘরে একটি তালিকা ঝুলিয়েছেন□□

!!! আব্বু-আম্মুদের গৃহ-সংবিধান !!!

☛ (এক) সময়মতো সালাত!

☛ (দুই) কথা বলার সময় দু’টি শব্দ কিছুতেই ভোলা চলবে না

✍ ক. মিন ফাদলিক, অনুগ্রহ করে............!

✍ খ. শুকরান, ধন্যবাদ-জাযাকাল্লাহু খাইরান!

☛ (তিন) কোনও মারামারি চলবে না। গালাগালি চলবে না। রুচি বিগর্হিত কোনও শব্দও উচ্চারণ করা চলবে না।

☛ (চার) পরিপূর্ণ আদব ও স্পষ্টতার সাথে নিজের কথা খুলে বলা।

☛ (পাঁচ) যা খুলেছ নিজেই তা বন্ধ করবে (দরজা-জানালা-তাক-কৌটা-বাক্স)।

যা ফেলে দিয়েছ যথাস্থানে তুলে রাখবে, ঘরের প্রতিটি স্থানকে আগের চেয়ে সুন্দর করে রাখবে!

☛ (ছয়) তোমার কামরা তোমার দায়িত্ব। পরিচ্ছন্নতা, বিন্যাস, পরিপাটি।

☛ (সাত) যেই কথা বলুক, তাকে না থামিয়ে পরিপূর্ণ মনযোগ দিয়ে তার কথা শ্রবণ।

☛ (আট) ঘরে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় সালাম।

☛ (নয়) প্রতিদিন এক পারা করে কুরআন তিলাওয়াত।

☛ (দশ) রাত দশটার পর আর জেগে থাকা নয়।

☛ (এগার) গেমস প্রতিদিন এক ঘণ্টা। রাত ৮ থেকে নয়টা।

☛ (বারো) আম্মু আব্বুকে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাবে। তাদের কপালে চুমু দিবে।

☛ (তেরো) রাত আটটার মধ্যে পড়াশোনা বাড়ির কাজ শেষ করা।

☛ (চৌদ্দ) ঘরের সমস্ত আসবাব-পত্রের হেফাজতের দায়িত্ব সবার।

☛ (পনের) আম্মু-আব্বু ছাড়া সবাই নিজের কাজ নিজেই করবে। অপরকে আদেশ করবে না।

☛ (ষোল) সবকিছুর উপর পরিবারের অগ্রাধিকার থাকবে। যে কোনও কিছুর আগে পরিবারের প্রয়োজন প্রথমে পুরণ করতে হবে।

☛ (সতের) দরজায় টোকা ও অনুমতি ছাড়া একে অপরের কামরায় প্রবেশ করা হবে না।

☛ (আঠার) কোনও পরিস্থিতিতেই গলার আওয়াজ উঁচু করা যাবে না।

☛ (উনিশ) সুস্থতা ও পরিচ্ছন্নতা (দেহ পোশাক দাঁত নখ) ও শরীরচর্চাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

☛ (বিশ) সবার সাথে উত্তম আচরণ সুন্দর ব্যবহার করা।

∮rom: Atik Ullah

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□সাত যিকির! □□

কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফে বেশি বেশি যিকির করার কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন জাগে:

-কোন যিকির করবো?

-নামাযের পর, কুরআন কারীম তিলাওয়াতই শ্রেষ্ঠ যিকির! তারপরও অভিজ্ঞজনেরা অনেক যাচাই-বাছাই করে সাতটা যিকির তুলে এনেছেন। এগুলোই মুমিন বান্দার সেরা অস্ত্র হিশেবে কাজ করবে। শয়তানের বিরুদ্ধে। দুঃখ-কষ্টের বিরুদ্ধে। শোক-দুশ্চিন্তার বিরুদ্ধে। মানসিক রোগবালাইয়ের বিরুদ্ধে। বিষন্নতার বিরুদ্ধে। ক্ষুধামন্দার বিরুদ্ধে। দুর্ভিক্ষ-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। গুনাহ-মাসিয়াতের বিরুদ্ধে।

-

(১) প্রথম যিকির: কুরআন কারীম তিলাওয়াত।

যতবেশি পারা যায় তিলাওয়াত করা। কিছুই না পারলে, সূরা ফাতেহাটা হলেও বারবার পড়া। ওটাও যদি মুখস্থ না থাকে: আউযুবিল্লাহ বা বিসমিল্লাহ পড়তে থাকা। কারণ এ-দু’টিও কুরআনের আয়াত। আস্তে আস্তে কুরআন শেখার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

.

(২) দ্বিতীয় যিকির: দুরূদ শরীফ। বেশি বেশি দুরূদ শরীফ পাঠ করা।

দুরূদ শরীফ সৌভাগ্যের প্রতীক। দুনিয়া আখেরাতে কামিয়াবির সোপান। একসাথে আল্লাহ তা‘আলা ও নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুশি হওয়ার কার্যকর মাধ্যম। প্রতিদিন যত বেশি পারা যায়। আমার দুরূদ পাঠের পরিমাণের সাথেই আমার সৌভাগ্যের পরিমাণ নির্ধারিত হবে।

সুযোগ পেলেই বলতে পারি:

صلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ

আল্লাহ তার প্রতি রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন।

.

(৩) তৃতীয় যিকির: ইস্তেগফার। ক্ষমা প্রার্থনা করা। সুযোগ পেলেই বলা:

-আস্তাগফিরুল্লাহ (ﺃﺳﺘﻐﻔﺮ ﺍﻟﻠﻪ)! আমি ক্ষমা চাই।

একটু ফাঁক পেলেই চট করে পড়া। দিনেরাতে শয়ে নয় হাজারের কোটায় নিয়ে যাওয়া।

.

(৪) চতুর্থ যিকির: বেশি বেশি ‘ইয়া যালজালালি ওয়াল ইকরাম (ﻳﺎﺫﺍﺍﻟﺠﻼ‌ﻝﻭﺍﻹ‌ﻛﺮﺍﻡ) বলা।

হে মহিমা ও সম্মানের অধিকারী! নবীজি বলেছেন:

ﺃﻟﻈّﻮﺍ ﺑـ ﻳﺎ ﺫﺍ ﺍﻟﺠﻼ‌ﻝ ﻭﺍﻹ‌ﻛﺮﺍﻡ

তোমরা নিয়মিত বেশি বেশি ‘ইয়া যালজালালি ওয়াল ইকরাম’ বলো! (তিরমিযি)।

.

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ-দু’টি নাম বেছে নেয়ার কারণ হলো:

ক. জালাল শব্দটার মধ্যে জামাল-সৌন্দর্য, কামাল-পরিপূর্ণতা, আযমত-বড়ত্ব ফুটে ওঠে!

খ. ইকরাম শব্দটার মধ্যে আতা‘-বৃষ্টির মতো দান, জূদ-উদারহস্তে প্রদান ফুটে ওঠে!

শব্দদু’টির অর্থের দিকে খেয়াল করলে বোঝা যায়, আমি একই সাথে রাব্বে কারীমের উচ্চতর প্রশংসা করছি আবার পাশাপাশি তার কাছে ‘প্রার্থনা’ করছি। ভিক্ষা করছি। নিজের অভাবের কথা তুলে ধরছি। তার কাছে নিজের অসহায়ত্বকে বিনীতভাবে পেশ করছি। আমি যিকিরটা করলে, এটা তো নিশ্চিত: আল্লাহ ভীষণ খুশি হবেন। আর তিনি খুশি হলে আর কিছু লাগে? তিনি আমার অভাব-অনটন, চাওয়া-পাওয়ার কথা তো জানেনই! আর চিন্তা কিসের! ভাবনা কিসের! তিনি দুকূল চাপিয়ে উপচে দেবেনই দেবেন!

.

(৫) পঞ্চম যিকির: লা হাওলা ওয়ালা কুউয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।

ﻻ‌ ﺣﻮﻝ ﻭﻻ‌ ﻗﻮﺓ ﺇﻻ‌ ﺑﺎﻟﻠﻪ

আল্লাহ ছাড়া কোনও শক্তি ক্ষমতা নেই।

নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক সাহাবীকে এই যিকিরটা করতে বলেছেন। বারবার তাকিদ দিয়েছেন। বাক্যটা সম্পর্কে নবীজির অবিস্মরণীয় মন্তব্য হলো:

ﻛﻨﺰ ﻣﻦ ﻛﻨﻮﺯ ﺍﻟﺠﻨﺔ

জান্নাতের অন্যতম ধনভাণ্ডার!

.

সময়-সুযোগমতো যিকিরটা নিয়মিত করতে পারলে, জীবনের প্রতিটি পরতে এক আজীব প্রভাব ফুটে ওঠে। আল্লাহর নেয়ামতের নহর আমার উপর বয়ে যাবে। এমনিতেই কি কম নেয়ামত ভোগ করছি! নাক? চোখ? হাত? পা? বাক্যটা উচ্চারণ করাটা ইবাদত তো বটেই, পাশাপাশি আমি পরোক্ষভাবে এটাও কি বলছি না(?):

-মাবুদ গো! আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই! আপনার দান ছাড়া আমার কিছুই নেই! আপনি ছাড়া আর কেউ দেয়ার মতোও নেই! আপনি আমাকে দিয়ে দিন! সব সব সব!

.

(৬) ষষ্ঠ যিকির: এবার সরাসরি কুরআনের আয়াত। এবং সেটা একজন নবীর মুখনিঃসৃত দু‘আ। লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহা-নাকা ইন্নী কুনতু মিনয-যলিমীন:

ﻻ‌ ﺇﻟﻪ ﺇﻻ‌ ﺃﻧﺖ ﺳﺒﺤﺎﻧﻚ ﺇﻧﻲ ﻛﻨﺖ ﻣﻦ ﺍﻟﻈﺎﻟﻤﻴﻦ

(হে আল্লাহ!) আপনি ছাড়া কোনও মাবুদ নেই। আপনি সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র। নিশ্চয়ই আমি অপরাধী (আম্বিয়া: ৮৭)।

.

কেউ ছিল না। কোনও সহায় ছিল না। উপায় ছিল না। সম্বল ছিল না। মাছের পেটে ঘুটঘুটে আঁধারের মধ্যে ছিলেন। বাঁচার কোনও আশাই ছিল না। ইউনুস আ. মরিয়া হয়ে দু‘আটা পড়তে শুরু করলেন। ফলাফল সবার জানা। একটা দু‘আতেই কেটে যাবে যাবতীয় দুঃখ-শোক। শুধু তাই নয়, আমাকে পৌঁছে দেবে মুক্তির আনন্দবন্দরে!

.

(৭) সপ্তম যিকির: সুবহানাল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ। লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ। আল্লাহু আকবার:

ﺳﺒﺤﺎﻥ ﺍﻟﻠﻪ ، ﺍﻟﺤﻤﺪﻟﻠﻪ ، ﻻ‌ﺍﻟﻪ ﺍﻻ‌ﺍﻟﻠﻪ ،ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻛﺒﺮ

আমি ঘোষণা করছি, আল্লাহ সকল ত্রুটি থেকে মুক্ত। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্যে। আল্লাহ ছাড়া নেই কোনও উপাস্য। আল্লাহ মহান।

.

.

একটি অব্যর্থ মূলনীতি: দু‘আ ও যিকির কার্যকর হওয়ার একমাত্র উপায় হলো:

ক. বেশি বেশি বারবার করা।

খ. মরিয়া হয়ে করা। জোরাজুরি চাওয়া। আল্লাহর কাছে পীড়াপীড়ি করা। দিতেই হবে। দিয়েই দিন।

গ. যা বলছি, যা করছি, বুঝে বুঝে বলা ও করা।

.

অবশ্য অবশ্য অবশ্য লক্ষ্যণীয়:

ক. আমি যত বেশি যিকির করবো, ততবেশি আল্লাহর মহব্বত লাভ করবো।

খ. আমি যতবেশি পীড়াপীড়ি করে দু‘আ করবো, ততবেশি আমার দু‘আ কবুল হবে।

গ. আমি যত বেশি দু‘আ-যিকির করবো, শয়তান-বিপদ-বালামুসিবত-জাদু-টোনা-বিষ আমার থেকে দূরে হটবে!

.

সাতটা যিকিরের বাইরে আর কোনও যিকির নেই, এমন নয়। উপরোক্ত যিকিরগুলোর প্রতি কুরআন-হাদীসে বেশি তাকিদ এসেছে, এজন্যই বলা। নইলে এর বাইরেও অনেক যিকির আছে। আবার প্রতি নামাযের পর যিকির আছে। সকাল-সন্ধ্যার যিকির আছে। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে যিকির-দু‘আ আছে। সেগুলো আমাদের আলোচ্য বিষয় ছিল না। আমাদের আলোচ্য বিষয় ছিল সব সময়, বেশি বেশি যে যিকিরগুলো করার প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে সেগুলো। যিকিরগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো:

ক. যখন-তখন পড়া।

খ. যতবেশি সম্ভব পড়া।

.

ইয়া রাব! আমল করার তাওফীক দান করুন!

© Atik Ullah

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ভালবাসি আমি তোমাকে! □□

একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে: ৭২

-

চারপাশে প্রিয় মানুষের উপস্থিতি থাকলে, নিশ্চিন্তে কাজ করা যায়।

ঘরে-বাইরে সব জায়গায় পরিবেশটা অনুকূল হলে সময়-শ্রম-মেধার অপচয় রোধ করা যায়। অহেতুক ঝামেলা বাঁধে না।

-

নবীজি সা. চাইতেন সমাজে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকুক। সবার মধ্যে মিলমিশ থাকুক। সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি অটুট থাকুক।

নবীজি বারবার বলতেন, একজন আরেকজনকে আল্লাহর জন্যে ভালবাসতে।

-

(এক)

সাত প্রকারের মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা কেয়ামতের দিন ছায়া দান করবেন। এদের মধ্যে এক প্রকার হল:

দু’জন ব্যক্তি, আল্লাহর জন্যে একে অপরকে ভালবাসে, আল্লাহর ভালবাসার খাতিরে দু’জনে একত্রিত হয়। আল্লাহর ভালবাসার তাকিদেই দু’জনে বিচ্ছিন্ন হয় (বুখারী ৬২৯)।

-

(দুই)

নবীজি শুধু এটুকুতেই ক্ষান্ত হননি, তিনি তার সামাজিক সৌহার্দ্য ‘কার্যক্রম’ কিভাবে বাস্তবায়িত হবে, তার চমৎকার রূপরেখাও বাতলে গেছেন।

আমাদের নবীজির প্রধান একটা বৈশিষ্ট্য হল, তিনি ‘তত্ত্ব’ প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করতেন না। তত্ত্বের প্রায়োগিক দিকটাতেও সযত্ন নজর রাখতেন। নিজেই করে দেখাতেন। দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন। ভাইয়ে-ভাইয়ের মাঝে কিভাবে ভালবাসার বন্ধন তৈরি হবে?

-

কোনও ভাইকে ভাল লাগলে, তাকে জানিয়ে দেয়া: আমি আপনাকে ভালবাসি! (আবু দাউদ)।

-

লজ্জার কিছু নেই। সংকোচ কিসের। তাকে আমার ভাল লাগে। এই ভাল লাগাটা আল্লাহরই জন্যে। তাহলে এটা ইবাদত। এটা সুন্নাত।

আবার তাকে ভালবাসার কথা বলাও সুন্নাত। সুন্নাত আদায়ে পিছিয়ে থাকব কেন? জড়সড় হব কেন? পিছিয়ে থাকব কেন?

-

(তিন)

এক সাহাবী নবীজির দরবারে বসা ছিলেন। পাশ দিয়ে আরেক সাহাবী হেঁটে গেলেন। উপবিষ্ট সাহাবী বললেন:

ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি এই মানুষটাকে ভালবাসি!

- তুমি তাকে ভালবাসার কথা জানিয়েছ?

জ্বি না!

- যাও, তাকে (ভালবাসা) জানিয়ে আস!

সাহাবীটি দৌড়ে গেলেন। তার পছন্দের মানুষটাকে গিয়ে ধরলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন: আমি আপনাকে আল্লাহর জন্যে ভালবাসি!

- (দু‘আ করি), আপনি আমাকে যার জন্যে ভালবাসেন, তিনিও আপনাকে ভালবাসুন! (আবু দাউদ ৫১২৫)।

-

আমার সবকিছু কার জন্যে? আল্লাহর জন্যে। আমি একজন মুসলিম ভাইকে আল্লাহর জন্যেই ভালবাসব। পছন্দ করব। এই একটা সুন্নাতের বদৌলতে সমাজ, ঘর, রাষ্ট্রের চিত্র বদলে যেতে পারে। শুধু কি পার্থিব লাভ?

আখেরাতেও এর বিরাট প্রতিদান পাওয়া যাবে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সুখী দেখতে চেয়েছেন। সুখের ফর্মুলাও দিয়ে গেছেন। আমরা প্রয়োগ করব কি না, সেটা আমাদের যিম্মা! আজ পরীক্ষামূলক সুন্নাতটা আদায় করে দেখতে পারি!

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□সন্তানকে ভাল করে কিভাবে গড়ে তোলা যায়?□□

কুরআনি জামা‘আত: ২৬৭

(কুরআনকে ভালোবাসার একটি বিনম্র প্রয়াস)

--

সন্তানকে ভাল করে কিভাবে গড়ে তোলা যায়? অভিজ্ঞজনেরা সন্তানকে নেক হিশেবে গড়ে তোলার তিনটা ধাপ বলে থাকেন!

--

প্রথম ধাপ: অভিভাবকের সততা।

এবং তাদের পিতা ছিলেন একজন সৎলোক (কাহফ ৮২)।

= পিতাকে সৎ হতে হবে। মাতাকে সৎ হতে হবে। এটা সূচনা। বিসমিল্লাতে গলদ থেকে গেলে আমীনেও গলদ থাকার সম্ভাবনা!

মুসা আ. ও খিযিরের ঘটনার সেই দুই বালকের পিতা সৎ ছিলেন। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বিশেষ রহমতের আওতায় রেখেছিলেন।

--

দ্বিতীয় ধাপ: সন্তানের জন্যে দু‘আ।

আমার জন্যে আমার সন্তানদেরকেও (সেই) যোগ্যতা দান করুন (আহকাফ ১৫)।

= সন্তানের জন্যে দু‘আটা অপরিহার্য। বলতে গেলে দু‘আই সন্তান প্রতিপালনের প্রধান কাজ।

--

তৃতীয় ধাপ: নিজে নামাজ কায়েম করা। সন্তানকেও নামাজ কায়েমের আদেশ করা। এবং এজন্য দুআ করা।

হে আমার প্রতিপালক! আমাকেও নামায কায়েমকারী বানিয়ে দিন এবং আমার আওলাদদের মধ্য হতেও (এমন লোক সৃষ্টি করুন, যারা নামায কায়েম করবে) ইবরাহীম ৪০।

= সালাত যাবতীয় কর্মের মূলভিত। সালাত হল স্তম্ভ। এটা ঠিক হলে, বাদবাকি সব ঠিক হয়ে যাবে।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

ক্ষণিকা-মুহূর্তকথা:৩৫৪

*

একলোক লাইব্রেরিতে গেল। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর একটা বই পছন্দ হল। খুশিমনে বইটা নিয়ে টেবিলে পড়তে বসল। বইটা খুলতেই একটা হাতে বানানো ‘বুকমার্ক’ চোখে পড়ল। তাতে লেখা আছে:

*

-স্বাগতম! আপনি আমাকে চেনেন না, আমিও আপনাকে চিনি না।

আমাদের দুজনের কখনো দেখা হবে, এমন সম্ভাবনাও আপাতত নেই। দেখা হলেও দেখা যাবে আমাদের দুজনের মাঝে কোনও মিল নেই। চিন্তা, বিশ্বাস, ধর্ম, জাতি কোনও দিকেই না।

তবুও একটা ব্যাপার কি লক্ষ্য করেছেন, আমার আর আপনার মাঝে একটা মিল আছে! বলুন তো সেটা কী?

হাঁ, ঠিক ধরেছেন, এ-বইটা পছন্দ করার ব্যাপারে আমি আর আপনি এক! চলুন আমাদের ঐক্যটাকে উপভোগ করা যাক!

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ধূলোমলিন তালাক!□□

চট করে মাথায় রাগ উঠে যায়। এমন রগচটা হলে সংসার করা মুশকিল। স্ত্রী অনেকবারই একথা বলেছে। কে শোনে কার কথা! ঝগড়া শুরু করলে স্বামীর মুখের হাতের লাগাম থাকে না বললেই চলে। একদিন রাগের মাথায় বেসামাল মুহূর্তে বেফাঁস তালাক দিয়ে বলল,

‘ اليوم المشؤوم الاغبر الذي ليس به نور ’

তুমি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও। একমাত্র ‘অশুভ ধূলোমলিন আলোহীন’ দিনেই তুমি চাইলে আমার ঘরে ফিরতে পারবে’

.

স্ত্রীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। গুমরে কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ি চলে এল। স্ত্রী বেরিয়ে যেতেই রাগত স্বামীর ‘টং’ মাথার ‘জং’ নেমে গেল। হায় হায় করলাম কী? সব শেষ করে দিয়েছি। এখন উপায়? মনের দুঃখে স্বামী খাওয়া-নাওয়া শিকেয় উঠল। মুখে হাত দিয়ে ভাবনায় ডুবে গেল। কোনও কূলকিনারা করে উঠতে পারল না। দৌড়ে মসজিদে গেল। ইমাম সাহেবের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সব শুনে ইমাম পড়লেন জটিল সমস্যায়,

-আমি কোত্থেকে তোমার জন্য এমন ‘দিন’ খুঁজে আনব। তালাক দিয়েছ, এবার ঠ্যালা সামলাও। আবার এমন দিনে ফিরিয়ে আনার শর্ত দিয়েছ, যার কোনও অস্তিত্বই নেই।

.

জালিম স্বামী নতমুখে ঘরে ফিরে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবতে লাগল। কী করি? ভোর হলেই শহরে যেতে হবে। সেখানে বড় কোনও আলিমের কাছে হয়তো সমাধান থাকতে পারে। উফ! কী পাষণ্ড আমি, এমন হুরপরীর মতো ফিরিশতাতুল্য বউকে কেউ তালাক দেয়? কী জানোয়ার আমি! সারারাত এপাশ ওপাশ করে কেটে গেল। শেষরাতের দিকে চোখের পাতা ভারী হয়ে এর। দু’চোখে নেমে এল রাজ্যের ঘুম। পাখির ডাকে সম্বিত ফিরল। হায় হায়, ফজর কাযা হয়ে গেছে। কী হতভাগা আমি! এমন কষ্টের দিনেও কেউ ফজর বাদ দেয়?

.

যা হোক, ব্যাগ গুছিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে এল। পাশের ঘরে বিছানায় পড়ে থাকা বৃদ্ধা মায়ের কথা মনেও রইল না। পাশের গ্রামে এক বড় আলেম আছেন। তার কাছে ফতোয়া চাওয়া হল। শোনার সাথে সাথেই বলে দিলেন, এমন দিন কেয়ামতের আগেও আসবে না। সুতরাং বিবিকে ফিরিয়ে আনার আশা ছেড়ে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

.

রগচটা স্বামী হাঁটতে হাঁটতে শহরে পৌঁছল। ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে আসছে। তবুও বসতে ইচ্ছে হল না। একটা কিছু সমাধান না পেলে, এই জীবনে বেঁচে থাকার আশাই ধুলিস্মাৎ হয়ে যাবে। একটু জিরিয়ে নেয়ার আশায় দোকানের ছায়ায় বসল। রোদও পড়ছে ছাতিফাটা। আগন্তুকের মলিন চেহারা দেখে দোকানদারের বোধহয় মায়া হয়। আগবাড়িয়ে জানতে চাইল,

-কী মুসাফির! কোনও সমস্যা?

স্বামী সমস্যার কথা বলল। একজন অভিজ্ঞ আলিম দরকার। এই জটিল মাসয়ালার সমাধান যে সে দিতে পারবে না। দোকানদার বলল,

-শহরের শেষপ্রান্তে একজন দরবেশ থাকে। তার কাছে গিয়ে দেখতে পারো। এলেম-কালাম ভালোই আছে দরবেশ সাহেবের। তার গরীব বেশভূষা দেখে হতাশ হয়ো না।

.

স্বামী আশা ভরা পায়ে দরবেশের কাছে গেল। ঘটনা শুনে দরবেশ চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর স্বামী উশখুশ করতে লাগল। দরবেশ রাগত স্বরে বললেন,

-এমন গুণবতী বিবিকে যে সম্মান করতে জানে না, তার কাছে বিবিয়ে ফিরিয়ে আনার সমাধান দেয়াটা গুনাহের কাজ হবে। তোমার মতো জালিমের শাস্তি হওয়া দরকার। তারপরও যেহেতু তুমি অনুতপ্ত হয়েছ, শেষবারের মতো একটা সুযোগ দেয়া যেতে পারে। কিছু প্রশ্নের উত্তর দাও

-আজ ফজরের নামায পড়েছ?

-জি¦ না। উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।

-যা প্রশ্ন করি, শুধু তার উত্তর দেবে। অতিরিক্ত কথা বলবে না। সাফাই গাইবে না। আজ মায়ের সেবা করেছ?

-জি¦ না। কারণ...

-চোওওপপপ! কারণ দর্শাতে নিষেধ করেছি না। আজ কুরআন তিলাওয়াত করেছ?

-জি¦ না। মানে

-আবার....! শোন বদবখত জালিম, আজ সুয্যি ডোবার আগে আগে, দৌড়ে গিয়ে বিবিকে রুজু করে নে।

-দরবেশবাবা, কী করে সম্ভব হল?

-শোন খবীস! আজ ফজর পড়লি না। মায়ের সেবা করাতো দূরের কথা, বৃদ্ধমায়ের মুখও দর্শন করলি না। গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে এলি, মায়ের অনুমতিটুকু নেয়ার প্রয়োজন মনে করলি না। মুসলিম হয়েও আল্লাহর পাক কালাম হাতে নিয়ে দেখলি না। এর চেয়ে অশুভ আর আলোনূরহীন দিন হতে পারে?

.

বিকেল হতে আর বেশি বাকী নেই।

স্বামী পড়িমরি করে দৌড় দিল।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□হুর!□□

পাহাড়ী পথ। বেচারা ধার্মিক মানুষ। যিকিরে-ফিকিরে গাড়ি চালাচ্ছে। পেছন থেকে আসছিল সামরিক বাহিনীর এক বহর। একটি গাড়ির ব্রেক ফেল হওয়াতে সামনের গাড়িকে ধাক্কা দিল। গাড়ি পড়ে গেল গভীর খাদে। সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মীরা এসে চালককে উদ্ধার করে দ্রুত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করল। ডাক্তাররা সর্বোচ্চ চেষ্টা করল। লোকটির সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনতে।

দু’দিন পর লোকটি লুপ্ত চেতনা ফিরে পেল। চোখ মেলেই সামনে দেখতে পেল ধবধবে শাদা, সুন্দর এক রূমে দুগ্ধ ফেননিভ কোমল বিছানায় শুয়ে আছে। পাশে এক মহিলা তার হাতের শিরা ধরে বসে আছে। প্রথমেই জানতে চাইল,

-আমি কি মারা গেছি?

মহিলার চোখে কৌতুকের ঝিলিক। একটু ভেবে উত্তর দিল,

-জি¦!

-এত সুন্দর আরামদায়ক বিছানা, আমি কি জান্নাতে আছি?

-জি¦, আপনি জান্নাতেই আছেন।

লোকটার দু’চোখ ছানাবড়া। আস্তে আস্তে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল মহিলার উপর। দৃষ্টিটা কেমন যেন নিষ্প্রভ। হতাশ। মিইয়ে যাওয়া স্বরে জানতে চাইল,

-আপনি বুঝি আমার হুর?

নার্স খিলখিল করে হেসে বলল,

-ঠিক ধরেছেন!

লোকটা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। নার্স অবাক। কী ব্যাপার? লোকটা হুরের কথা শুনে কেঁদে উঠল কেন? লোকটা কাঁদতে কাঁদতে আপন মনে বিড়বিড় করে বলছে,

- ও আল্লাহ! দুনিয়াতে সংসারজীবনে অনেক সবর করেছিলাম। বাবা আমার অমতেই টাকার লোভে একজনের সাথে বিয়ে করিয়ে দিয়েছিলেন। তাকে প্রথমবার দেখেই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারপরও সবর করেছিলাম। ভেবেছিলাম জান্নাতে এর বদলা পাব। কিন্তু হুরকে দেখে মনে হল, দুনিয়ার বিবি এর চেয়ে হাজারগুণে ভালো ছিল।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

(০৩-০৮-১৯)

মহিলা ‘ইমাম’!

-

১: মহিলারা কি পুরুষেরও ‘ইমাম’ হতে পারবেন? জ্বি, কুরআনে এমনটাই আছে। মহিলারা মুত্তাকীগনের ইমাম হতে পারবেন। তবে কথা আছে।

২: কুরআন কারীমে ইমাম শব্দটা সর্বমোট ১২বার উল্লেখিত হয়েছে। ইমাম শব্দটি কুরআনে ৭-টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে,

ক: কল্যাণ কাজের নেতা বা আদর্শ।

খ: শয়তান বা কাফেরদের নেতা।

গ: মানুষের আমলনামা।

ঘ: লওহে মাহফুয।

ঙ: তাওরাত।

চ: সুস্পষ্ট প্রশস্ত রাজপথ।

৩: ইমাম বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, মসজিদের ইমাম বা নামাজের ইমাম। এই প্রচলিত অর্থে ‘ইমাম’ শব্দটি কুরআন কারীমে একবারও ব্যবহৃত হয়নি।

৪: কুরআন কারীমের দু‘আগুলো সবার জন্য। অবাধ। উন্মুক্ত। উদার। নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য। দু‘আগুলো প্রতিটি মুমিনের জন্য। এমনকি প্রতিটি মানুষের জন্য। যারা মুসলিম নয়, তাদের জন্যও দু‘আগুলো পড়ার ঢালাও অনুমতি। কুরআন তো সবার জন্য,

رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ أَزۡوَ ٰ⁠جِنَا وَذُرِّیَّـٰتِنَا قُرَّةَ أَعۡیُنࣲ وَٱجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِینَ إِمَامًا

হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের পক্ষ হতে দান করুন নয়নপ্রীতি এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন (ফুরকান ৭৪)।

৫: দু‘আটির বক্তব্য পুরুষঘেঁষা হলেও, নারীরাও এই দু‘আ করতে পারবেন। দু‘আর শেষাংশে আছে (وَٱجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِینَ إِمَامًا)। আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন। একজন নারীও মুত্তাকীদের ইমাম হতে পারেন।

৬: ইমাম হতে হলে, মিম্বর মেহরাবে দাঁড়াতে হবে? এমন শর্ত কুরআন ও সুন্নাহর কোথাও নেই। আমি ইমাম হতে পারি মুচকি হাসিতে। আমি ইমাম হতে পারি পরোপকারে। আমি ইমাম হতে পারি সবরে।

৭: হাঁ, মসজিদে নামাজের ইমাম হতে হলে পুরুষ হওয়া শর্ত। ঈমানে, আমলে, সততায়, শিক্ষায়, দীক্ষায়, আদর্শে ইমাম হতে হলে, পুরুষ হওয়ার শর্ত নেই। একজন নারীও পৃথিবীর সমস্ত পুরুষের, সমস্ত মুত্তাকীদের ইমাম হতে পারেন। আদর্শ হতে পারেন। আম্মাজান আয়েশা রা. আমাদের ইমাম। উমার বিন আবদুল আজীজ রহ.-এর সহধর্মিনী আমাদের ইমাম। খলীফা হারুনুর রশীদের স্ত্রী জুবায়দা আমাদের ইমাম। তারা আদর্শ দিয়েই আমাদের ইমাম হয়েছেন।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□তাওবা!□□

(০২-০৮-১৯)

১: কিছু বিষয় থাকে, তাতে কোনও ইতরবিশেষ নেই। সবাই সমান। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, আল্লাহর দেয়া বাতাস সবাই সমানভাবে অবাধে গ্রহণ করে। আল্লাহর দেয়া পানি সকলেই অবাধে ব্যবহার করে।

২: আমল-ইবাদতের ক্ষেত্রেও একই কথা। কিছু আমল-ইবাদত আছে, কোনও বাছবিছার ছাড়া সবার জন্য প্রযোজ্য।

৩: কুরআন কারীমের আয়াতের বেলায় একই কথা। কিছু আয়াত আছে, কোনও মুসলিমই তার আওতামুক্ত নয়। তেমন একটি আয়াত হল,

تُوبُوۤا۟ إِلَى ٱللَّهِ جَمِیعًا

তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে তাওবা কর (নূর ৩১)।

৪: আল্লাহ বলেছেন (جَمِیعًا) সকলেই। কেউ বাকী নেই। এই কুরআনি বাক্যটি সমস্ত আমিত্বকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয়। প্রতিটি মুসলিম তাওবার মুহতাজ (মুখাপেক্ষী)। কারণ, নবীগন ছাড়া কেউই নিষ্পাপ নয়।

৫: এই আয়াত, আমার মধ্যে তাওবার প্রতি দায়িত্ববোধ গড়ে না তুললে, আমার ঈমানে ঘাটতি আছে বুঝতে হবে। কেউ নিজেকে এই আয়াতের আওতামুক্ত ভাবলে, ধরে নিতে হবে, তার মধ্যে চরম মাত্রার অহংকার বিরাজমান।

৬: তাওবা কি শুধু পাপীর? আমি ইমাম, আমি হুজুর, আমি দাঈ, আমি মুবাল্লিগ, আমি পীর, আমি মুজাহিদ কমান্ডার, আমি গাড়ি নিয়ে ইস্তেশহাদী হতে যাচ্ছি, আমি তাহাজ্জুদগুজার, আমি দানবীর, আমি হাজি, আমি গাজী, আমি যা-ই হই, আমাকে তাওবা করতে হবে। তাওবা করে যেতে হবে।

৭: দুনিয়ার কেউই তাওবার বিধানের আওতামুক্ত নয়। জামী‘আন-সকলকেই তাওবা করতে বলা হয়েছে। আমি বড় হুজুর হলেও, আমাকে নিয়মিত তাওবা করতে হবে। আমি বড় নেতা হলেও, আমাকে সবসময় তাওবার উপর থাকতে হবে। আস্তাগফিরুল্লাহ ওয়া আতূবু ইলাইহি।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□শুদ্ধতার সনদ!□□

(০১-০৮-১৯)

1: কুরআন কারীম হাতে নিলে, পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে প্রায়ই অজান্তে সূরা নূরে চলে যাই। সবচেয়ে প্রিয় তিনজন মানুষের কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করি। ইফকের আয়াতগুলো পড়ে, চুপচাপ হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। নবীজি সা., আবু বকর ও আয়েশা রা.-এর সীমাহীন মনোবেদনার কল্পনা করে, মনটা ছটফট করে ওঠে।

2: পাশাপাশি কল্পনার চোখে দেখার চেষ্টা করি, সাফওয়ান বিন মু‘আত্তাল রা.-কে। যার সাথে আম্মাজান আয়েশা রা.-কে জড়িয়ে মুনাফিকরা মদীনায় কুৎসা রটনা করেছিল। ওই দুর্যোগময় সময়ে, প্রায় মাসখানেক ওহী আসা বন্ধ ছিল। সেই অন্তবর্তী সময়ে, ফুলের মতো নিষ্পাপ চরিত্রের অধিকারী, হযরত সাফওয়ান লজ্জায় কতটা অধোবদন হয়ে মদীনায় বাস করেছিলেন? ইফকের আলোচনায়, আম্মাজানের কষ্টের কথা সবার বেশি মনে থাকলেও, এই অধমের কেন যেন, সাফওয়ান রা.-এর কষ্টের কথাও মনে পড়ে।

3: ইফকের আয়াতগুলো শেষ করে সামনে এগুলেই আসে, গৃহে প্রবেশ সংক্রান্ত আয়াত। এখানে এসে থমকে দাঁড়াই। একটা না পাওয়ার বেদনা বুকের গহীনে চিনচিন করে ওঠে।

4: এমন কি হয় না, একটা আমল করার জন্য সবসময় মনটা ছটফট করে, কিন্তু কিছুতেই আমলটা এসে ধরা দেয় না। তাওফীক হয় না। বারবার চেষ্টার করার পরও আমলটা নসীবে জোটে না?

5: একটি আমল আছে, খুবই সহজ। আমলটা করতে পারলে, আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট স্বীকৃতির নিশ্চয়তা। অনেকবার চেষ্টা করেও আমলটা করে উঠতে পারছি না। আমল না বলে ‘আখলাক’ বলাই শ্রেয়।

6: আমলের আয়াতটা পড়ি,

فَإِن لَّمۡ تَجِدُوا۟ فِیهَاۤ أَحَدࣰا فَلَا تَدۡخُلُوهَا حَتَّىٰ یُؤۡذَنَ لَكُمۡۖ وَإِن قِیلَ لَكُمُ ٱرۡجِعُوا۟ فَٱرۡجِعُوا۟ۖ هُوَ أَزۡكَىٰ لَكُمۡۚ

তোমরা যদি তাতে (ঘরে) কাউকে না পাও, তবুও যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদেরকে অনুমতি দেওয়া না হয়, তাতে প্রবেশ করো না। তোমাদেরকে যদি বলা হয়, ‘ফিরে যাও’ তবে ফিরে যেও। এটাই তোমাদের পক্ষে শুদ্ধতর (নূর ২৮)।

7: কোনও কোনও মুহাজির সাহাবী, আজীবন আক্ষেপ করে গেছেন, এই আয়াতের শেষাংশের উপর আমল করতে না পেরে। আক্ষেপ করার মতোই একটি আমল।

৫: আমলটা কী? আমি কারও বাড়ি গেলাম। দরজায় টোকা দিলাম। ভেতর থেকে আওয়াজ এল, এখন দেখা করতে পারব না, ফিরে যাও। আমি বিনাবাক্যব্যয়ে ফিরে গেলাম।

8: ঘটনা এমনটা ঘটলে, রাব্বে কারীমের দৃষ্টিতে আমার ফিরে যাওয়াটা কেমন? আমার ফিরে যাওয়াটা হবে (أَزۡكَىٰ) শুদ্ধতর একটি কাজ। আমার রবের কাছে আমি একজন ‘শুদ্ধতর’ বান্দা।

9: আমলটা জীবনে একবারও করার সুযোগ হয়নি, এমন নয়। বেশ কয়েকবার হয়েছে। কিন্তু তখন আমলটা সম্পর্কে সচেতন ছিলাম না। এমনও হয়েছে, গভীর রাতে অসহায়ের মতো আশ্রয়ের জন্য গিয়েছি। দরজা থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রচণ্ড শীতে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে মাহফিলের খোলা মাঠে পুরো রাত কাটাতে হয়েছে।

10: মাঝেমধ্যে একটা প্রশ্ন জাগে, অনেকে আছেন, পেশাগত কারণে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। তারা হয়ত নিয়মিত এই আমলের আওতায় পড়েন। ব্যবসার জন্য বা ভিক্ষার জন্য গেলে, তারা কি ‘আযকা’ বা শুদ্ধতর হবেন? মনে হয় না।

11: কয়েকটা কৌতুহল জানিয়ে রাখি, উত্তর জানার আগ্রহে নয়, এমনি জানানো,

ক: কেউ কি আছেন, যিনি আমলটা করে আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘সনদ’ লাভের চেষ্টা করেন?

খ: প্রিয় মানুষগুলোর কষ্ট অনুভব করার জন্য, সময়ে সময়ে সূরা নূর খুলে বসা হয়?

গ: সাফওয়ান বিন মু‘আত্তাল রা.-এর কষ্টের কথা আলাদা করে মনে পড়েছিল কখনো?

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□আল্লাহর ভালোবাসা!□□

(৩১-০৭-১৯)

-

১: আমি নিজেকে মুমিন বলে দাবি করি। মুমিনগণই আল্লাহকে ভালোবাসেন। কাফেররা আল্লাহকে ভালোবাসার দাবি করলেও, তা মিথ্যা। কুরআন কারীমে বলা হয়েছে,

وَٱلَّذِینَ ءَامَنُوۤا۟ أَشَدُّ حُبّا لِّلَّهِۗ

তবে যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকেই সর্বাপ্রেক্ষা বেশি ভালোবাসে (বাকারা ১৬৫)।

২: আল্লাহর প্রতি আমার ভালোবাসা কি সত্যি সত্যিই সর্বাপ্রেক্ষা বেশি? আমার কাজকর্ম, আচার-আচরণে কি সেটা প্রকাশ পায়?

৩: কিছু আলামত আছে, তা দিয়ে বোঝা যায়, আল্লাহর প্রতি আমার ভালোবাসা কেমন। মৌলিকভাবে,

ক: ব্যক্তিগত কাজের কারণে বা দুনিয়ার কারণে, ফরয বিধান আদায়ে বিলম্ব করা।

খ: পাপকাজে লিপ্ত থাকা।

গ: হালাল-হারামের ব্যাপারে উদাসীন থাকা।

ঘ: আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল থাকা।

৪: এসব আমার মধ্যে থাকলে, বুঝে নিতে হবে, আল্লাহর প্রতি আমার ভালোবাসা সর্বাপ্রেক্ষা বেশি নয়। আমি কুরআনি মানদণ্ডে পরিপূর্ণ মুমিন নই।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□বিয়ে!□□

-

বিয়ে মানে লাখ লাখ টাকা মোহরানার ফুটানি নয়।

বিয়ে মানে জাঁক-জৌলুসের বাহারি চমক নয়।

বিয়ে মানে চাকচিক্যের অপরিমিত দেখানোপনা নয়।

বিয়ে মানে একটি ‘সুখিগৃহ’-এর নাম।

যার ভিত ‘আল্লাহর আনুগত্য’-এর উপর স্থাপিত।

যার খুঁটি সহনশীল পরস্পরকে বোঝাপড়াময় দু’টি হৃদয়।

যার ছাদ হবে (إِیَّاكَ نَعۡبُدُ وَإِیَّاكَ نَسۡتَعِینُ) আমরা আল্লাহরই ইবাদত করি। আমরা আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাই।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□শ্রমিক!□□

শহরের মূলকেন্দ্রে প্রতি ভোরে ভীড় জমে যায়। নানা পেশার মেহনতি মানুষেরা এসে জড়ো হয়। শহর ও শহরতলির লোকজন এসে একদিন বা কয়েকদিনের জন্য তাদের ভাড়া করে নিয়ে যায়। সেদিনও মিনতি-মজদুররা জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চেহারায় উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ, আজ কাজ হতে তো? কেউ আছে গতকাল কাজ হয়নি! কারও গত কয়েকদিন ধরে কাজ জোটেনি। আজ না জুটলে না খেয়ে থাকতে হবে। বাড়িতে ছাওয়ালগুলোর না খেয়ে থাকতে হবে। একহপ্তা আগে সামান্য কিছু টাকা পাঠিয়েছে, এতদিনে সব ফুরিয়ে গেছে নিশ্চয়ই। মোবাইল নেই। যোগাযোগ করতে হলে পাশের বাড়িতে যেতে হয়। বারবার গেলে বিরক্ত হয়। ছোট খোকাটার দু’সপ্তাহ যাবত জ্বর-সর্দি-কাশি। ওষুধ কেনার টাকা নেই। হাঁড়িতে চাল নেই, চুলোয় আগুন নেই, ওষুধ আসবে কোত্থেকে?

একটা গাড়ি বা রিকশা এসে থামে, সবাই রাজ্যের কৌতুহল আর আগ্রহ নিয়ে তাকে ঘিরে ধরে। যদি কাজ জুটে যায়! সবার কাজ জোটে না। আবার অপেক্ষা। আরেকটি গাড়ি আসে। সবল তাগড়া দেখে বাছাই করে কুলি-কামীন সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। নির্বাচিতদের চোখেমুখে ফুটে ওঠে রাজ্যের পরিতৃপ্তি আর নিশ্চিন্তি। বাকিরা অনিশ্চিত মনে প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকে। সময় পেরিয়ে যায়। ঘড়িতে আটটা, নয়টা পেরিয়ে দশটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই করে। তখনো অনেক মানুষ কাজহীন। কোটরাগত চোখে, ভাঙাগালে উপোসী মানুষগুলো ক্ষুধার জ্বালায় দিনেদুপুরে জোনাকি দেখতে থাকে।

সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও, পোটলা-বুঁচকি হাতে কিসের আশায় যেন বসে থাকে।

একটি গাড়ি এসে থামল। গায়ে-গতরে মর্দানদের চোখের আশার ঝিলিক দেখা দিল। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া কামীনরা গাড়ি দেখেও উৎসাহ পায় না। হাঁড়ভাঙা খাটুনি করতে না পারলে, মহাজনরা তাদের নেবেই বা কেন? তারা বসেই থাকে। গাড়ির চালক উচ্চস্বরে হাঁক পাড়ল,

-আসা-যাওয়ার ভাড়া ও দুপুরের খাবার দিয়ে, সারাদিনের কাজের বিনিময়ে পঞ্চাশ টাকা করে দেয়া হবে।

সবাই বজ্রাহত! কী? সারাদিনে মাত্র পঞ্চাশ টাকা? তার চেয়ে না খেয়ে থাকাই ভাল। গাড়িঅলা আমার হাঁকল,

-কেউ থাকলে গাড়ির পেছনে উঠে বসো!

কেউ জায়গা ছেড়ে নড়ল না। গাড়িঅলা আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে উদ্যত হল। কয়েকজন জটলা ভেঙে হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে, আছড়েপিছড়ে হুড়মুড় করে উঠে এল। দু’জন বৃদ্ধা মহিলা। শনের মতো চুল আর পরনে শতচ্ছিন্ন তালিছাপ্পি মারা শাড়ি। আর বাকি তিনজনও বৃদ্ধ। ন্যূজ্ব। বয়সভারানত। হাতে কোদাল, কাস্তে আর বাঁশের বাখারি দিয়ে বানানো ‘ওড়া’। গাড়ি ছেড়ে দিল। শহরের আরেকপ্রান্তে এসে, গাড়ি থামিয়ে চালক নেমে এল। সবাইকে গাড়ি থেকে নামতে বলল। গাড়িতে রাখা বাক্স খুলে সবার হাতে একটা করে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিল। পকেট থেকে একতাড়া নোট বের করে সবাইকে মুঠো ভরে টাকা দিয়ে বলল,

-আমার কাজ শেষ। আপনার এবার যেতে পারেন।

একথা বলার সাথে সাথে ধূলি উড়িয়ে টিকিয়া উড়ান গতিতে হুশ করে গাড়িটি চলে গেল। পাঁচ বৃদ্ধ ঝাপসা চোখে অপসৃয়মাণ গাড়িছায়াটির দিতে তাকিয়ে, বিড়বিড় করে কী যেন বলাবলি করতে লাগল! গাড়ির আওয়াজে ঠিক বোঝা গেল না!

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□নবীগনের পেশা!□□

-

আদম আ. ছিলেন কৃষিজীবী। জমিতে চাষ করতেন। ফসল বুনতেন।

ইদরীস আ. ছিলেন খাইয়াত। প্রচলিত ভাষায় খলীফা। পোষাক সেলাই করতেন।

নূহ আ. ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। জাহাজ বানিয়েছেন।

ইবরাহীম আ. ছিলেন রাজমিস্ত্রি। কা‘বাঘর বানিয়েছেন।

ইলয়াস আ. ছিলেন তাঁতী। সুতো-কাপড় বুনতেন।

দাউদ আ. ছিলেন কামার। লৌহবর্ম বানাতেন।

মুসা আ. ছিলেন রাখাল। শ্বশুরবাড়ির মেষ চরাতেন।

ঈসা আ. ছিলেন ডাক্তার। দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করতেন।

মুহাম্মাদ সা. ছিলেন রাখাল। মক্কায় মেষ চরাতেন।

কোনও পেশাই ফেলনা নয়।

সব হালাল পেশাই সম্মানের।

আয়-উপার্জনের জন্য কায়িক শ্রমের পেশাকে ছোট করে দেখা গুনাহ।

মানুষকে পেশা দিয়ে মাপাও গুনাহ।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□বাবার শিক্ষা!□□

(২৫-০৭-১৯)

-

১: সন্তানের প্রথম শিক্ষক হলেন বাবা আর মা। বাবা সৎ হলে, সন্তান সাধারণত সৎ হয়ে থাকে। বাবার সততার প্রভাব সন্তানের উপর বেশি পড়ে আদর্শিক ক্ষেত্রে। মায়ের প্রভাব বেশি পড়ে আখলাকের ক্ষেত্রে।

২: আদর্শ আর আখলাকের মধ্যে পার্থক্য কী? আদর্শ চিন্তাগত দিক। আখলাক হল আচরণগত দিক। এ হল মোটাদাগের কথা। নইলে সন্তান বাবা-মা উভয়ের কাছ থেকেই আদর্শ-আখলাক শেখে। কুরআন আদর্শ ও আখলাক উভয় ক্ষেত্রেই বাবাকে সামনে এনেছে। বাবার ভূমিকাকে প্রধান করে দেখিয়েছে,

وَكَانَ أَبُوهُمَا صَـٰلِحا

আর তাদের দু’জনের পিতা ছিল সালিহ (পূণ্যবান)। কাহফ ৮২।

৩: এক পিতা সম্পর্কে সন্তানের শ্রদ্ধামুগ্ধ স্মৃতিচারণ,

-আমার আব্বুর কাছ থেকে জীবনের অনেক পাঠ পেয়েছি। আব্বু চেতনে-অবচেতনে আজীবন আমাদের শিখিয়ে গেছেন। আব্বুর কাছ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষাটা পেয়েছি, তা হল, আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল। তিনি শুধু মুখেই বলতেন, নিজের জীবনেরও এর বাস্তবায়ন ঘটাতেন। তিনি বলতেন,

‘‘ তুমি যখন বিপদে বা সংকটে পড়বে আর তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে শুরু করবে, প্রথমেই তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। তোমার মন-মগজ থেকে ‘গাইরুল্লাহকে’ বের করে দিতে হবে। গাইরুল্লাহ মানে হল, আল্লাহ ছাড়া যা কিছু আছে, সব। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে বের করে দেবে। কারও প্রতি বিন্দুমাত্র আশা রাখবে না। কেউ তোমাকে এই বিপদে সাহায্য করতে পারবে না। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই পারেন তোমাকে এই সংকট থেকে উদ্ধার করতে। এই শুদ্ধতম তাওয়াক্কুল ও বিশ্বাস নিয়ে রাব্বে কারীমের দরবারে নতজানু হবে। ইন শা আল্লাহ অবশ্যই সংকট কেটে যাবেই।

যখন দেখবে তুমি কায়মনোবাক্যে দু‘আ করার পরও সংকট কাটছে না, তাহলে বুঝে নিবে, তোমার ভেতরের কোথাও ‘গাইরুল্লাহ’ ঘাপটি মেরে আছে। আবার নবচিন্তায় ভেতরটাকে সাফ-সুতরো করে নেবে। তারপর দু‘আয় বসবে। ইন শা আল্লাহ বিপদ কেটে যাবে।

৪: ওই ভাই বলেছেন, আমি জীবনে বহুবার এটা পরখ করে দেখেছি। ফল পেয়েছি হাতেনাতে। অবিশ্বাস্যভাবে বিপদ কেটে গেছে। পেয়ারা নবীজি সা. অত্যন্ত সত্য বলেছেন,

ومن تعلَّق بشيءٍ وُكِل إليه

যে যার সাথে সম্পর্ক জুড়ে, তাকে তার সোপর্দ করা হয় (নাসাঈ ৪০৭৯)।

৫: উপরের হাদীসকে কেউ কেউ যঈফ বলেছেন কেউ হাসানও বলেছেন। কিন্তু রাব্বে কারীম তো অবশ্যই অবশ্যই সত্য বলেছেন,

وَمَن یَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسۡبُهُۥۤۚ

আর যে কেউ আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবে, তিনি তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন (তালাক ৩)।

৬: ওই ভাই তার বাবার যবানীতে আরেকটা কথা যোগ করেছিলেন। তার বাবা এও বলেছিলেন,

‘‘ বাছা, তোমাকে আরেকটা বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা রাখতে হবে। আমি সংকট বলে কোন ধরনের সংকট বুঝিয়েছি, সেটার স্বরূপ না জানলে, পরে আবার ঈমানে দুর্বলতা দেখা দেবে। আমি সংকট বলে বুঝিয়েছি ধর হঠাৎ অসুখে পড়লে বা হঠাৎ আর্থিক সংকটে পড়ে গেলে বা হঠাৎ নির্জন পথে তোমার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে বা তোমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না বা তোমার ব্যবসা মার খাচ্ছে ইত্যাদি।

৭: ‘‘কিন্তু কিছু বিপদ আছে ‘তাকবীনি’। মানে জগতপরিচালনা সম্পর্কিত। যেমন ধরো আমাদের ফিলিস্তীনের উপর চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। আমাদের শামের ভাইরা ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হচ্ছে। আমাদের উইঘুর মুসলিম ভাইয়েরা জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের মুখে পড়েছে। এ-ধরনের ব্যাপক বিপর্যয়ে, শুধু দু‘আ করলে সাধারণত তাৎক্ষণিক ফলোদয় হবে না। এ-ধরনের বিপর্যয়গুলোর সাথে অসংখ্য কারণ জড়িত থাকে। তুমি এমন বিপদে পড়লে অবশ্যই দু‘আ করবে। তখন সাথে সাথে কবুল না হলে, এই দু‘আর প্রতিদান অবশ্যই অন্যভাবে পবে। হয় দুনিয়াতে নয় আখিরাতে। ব্যক্তিগত বিপদাপদে যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছি, সেভাবে দু‘আ করবে, অবশ্যই ফল পাবে। জাতিগত বিপদ থেকে উত্তরণ একার দু‘আয় হয় বলে মনে হয় না।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□হকের মানদণ্ড!□□

১: ঈমান ও কুফরের এই মহাসমরে, কোনও মুসলিম দল বা ব্যক্তি হকের মানদণ্ডে আছেন কি না, এটা মাপার উপায় কী? উপায় রাব্বে কারীমই বলে দিয়েছেন,

ক: মুমিনগন পরস্পরের প্রতি দয়ালু হবেন (رُحَماءُ بَيْنَهم)।

খ: কাফেরের প্রতি অত্যন্ত কঠোর হবেন (أَشِدَّاءُ على الكُفَّار)।

২: আমার দল বা ঘরানার মধ্যে এই দুই বৈশিষ্ট্য আছে তো? যার মধ্যে যতবেশি এই দুই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকবে, তিনি ততবেশি মানদণ্ডে উত্তীর্ণ।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ক্যান্সারের নিরাময়!□□

১: আজকাল ক্যান্সার মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। রুগি ও রুগির পরিবার-পরিজনকে বড্ড অসহায় করে দেয় এই মরণব্যধি।

২: ক্যান্সার ও অন্যান্য দুরারোগ্যব্যধি থেকে বাঁচতে, আমরা দু‘আটা নিয়মিত পড়তে পারি,

(اللَّهمَّ إنِّي أعوذُ بك مِن البَرصِ والجنونِ والجُذامِ وسيِّئِ الأسقامِ)

৩: আল্লাহুম্মা! আমি কুষ্ঠরোগ, পাগলামি ও যাবতীয় দুরারোগ্যব্যধি থেকে আপনার কাছে পানাহ (আশ্রয়) চাই।

আনাস বিন মালিক রা.। সহীহ ইবনে হিব্বান ১০১৭।

৪: নবীজি সা. নিয়মিত এই দু‘আ পড়তেন। আমিও অন্তত সুন্নাহ হিশেবেও পড়তে পারি।

.

.

আল্লাহুম্মা ইন্নী আ‘উযু বিকা, মিনাল বারাসি ওয়াল জুনুনি ওয়াল জুযামি ও সাইয়িয়িল আসক্কামি।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

মসজিদে গেলেন ভীষণ মনখারাপ অবস্থা নিয়ে। বের হয়ে এলেন হাসতে হাসতে।

কী ব্যাপার, আপনার দুঃখ-কষ্ট কোথায় গেল? রাব্বে কারীমের দরবারে সিজদা দিতে গিয়ে ঝরে পড়ে গেছে সব!

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

মুনাফিক ও কুকুরের মধ্যে মৌলিক একটি মিল হল, কুকুর লেজ নাড়ে, মুনাফিক নাড়ে জিহ্বা।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□হাসানাহ!□□

(০৮-০৭-১৯)

১: সালাফের ফকীহগণ কল্পনা করে করে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করতেন। তারপর সেগুলোর সমাধান ইজতিহাদের উসুল মেনে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বের করার চেষ্টা করতেন। বর্তমানের ফকীহগনও এমন করেন।

২: এটা ছিল তাদের ইলমচর্চচার অন্যতম ধরন। বেয়াদিব না হলে বলা যেতো, এভাবে ইলমচর্চা করাটা তাদের আনন্দ (বিনোদন) লাভেরও প্রধান মাধ্যম ছিল। সালাফের অনুসরণে, একাকি বসে থাকলে, কল্পনায় একটা বিষয় ভেবে নিয়ে, কুরআন কারীম থেকে তার সমর্থনে আয়াত বের করার চেষ্টায় নামা ‘অধমের’ প্রিয় একটি অভ্যেস। শতকরা ৯৮% ভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক আয়াত বের করতে ব্যর্থ হই। তাতে কি, গেমস খেলে সময় নষ্ট করার চেয়ে, আল্লাহর কালাম চষে ব্যর্থ মনোরথ হওয়াতেই অনেক আনন্দ। অনেক লাভ। অনেক সওয়াব (ইন শা আল্লাহ)।

৩: আজ একটি বিষয়ে আয়াত খুঁজতে বসলাম। বারবার মনের খাতায় সূরা আহযাব-তাহরীম-তালাক-নূর ওল্টাচ্ছিলাম। ব্যর্থ হয়ে মোবাইলে চেষ্টা করলাম। বের করতে পারলাম না।

৪: বিষয়টা ছিল, আজকাল বিয়ে করার জন্য খাস পর্দাকারী মেয়ে পাওয়া যাওয়া কঠিন কিছু নয়। আন্তরিকভাবেই তারা পর্দা-নিকাব পালন করেন। কিন্তু সবদিক দিয়ে দ্বীনদার হওয়ার পরও, কেউ কেউ গরীব ঘরে যেতে চান না। অন্যকথায় বলতে গেলে, কেউ কেউ পরিপূর্ণ পর্দানশীন হয়েও, আরাম-আয়েশে থাকতে চান। সংসারে কষ্ট করা মেনে নিতে পারেন না। না না, এই চাওয়াতে কোনও গুনাহ নেই। ভাল থাকতে চাইলে গুনাহ হবে কেন।

৫: সমস্যা হয়, কিছু দ্বীনদার ভাই, বা আমাদের মতো দ্বীনি ঘরানায় বাস করা মানুষ, যাদের গড়পড়তা মাসিক সম্মানী ৫ থেকে ৮ হাজারের মধ্যে, তাদের নিয়ে। তারা পর্দানশীন মেয়ে বিয়ে করে যদি দেখেন, নববধূর প্রসাধনী বা অন্য চাহিদা পূরণ করতেই পুরো ‘মাহিনা’ চলে যাচ্ছে, তাহলে সংসারে সুখ থাকবে?

৬: একটা মেয়ের প্রসাধনীর প্রতি আগ্রহ থাকা কি খারাপ? নাহ, তা কেন হবে। এটা তার স্বভাবজাত বিষয়। মৌলিক চাহিদার অংশও বলা যেতে পারে। কিন্তু আমরা স্বামী বেচারার কথা বলছি। পাত্রী দেখার সময় শুধু পর্দানশীন দেখলেই হবে না, পাত্রীর ‘কানা‘আত’ বা অল্পেতুষ্টির গুণ আছে কি না, সেটাও দেখা জরুরী। পাত্রীর দ্বীনদারির পাশাপাশি দেখা জরুরী, তার চাওয়া-পাওয়ার মাত্রা পাত্রের সঙ্গতির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ কি না?

৭: একজন মেয়ে বিয়ের পর সুখে থাকতে চাইবে। মেয়ের অভিবাবকও চাইবেন, মেয়েটা সুখে থাকুক। তাই তারা তেমন পাত্রই খোঁজেন। আমাদের মতো গরীব পাত্রের উচিত হল, পর্দা-হিজাব-নিকাব দেখেই, নিজের সামথ্যের কথা ভুলে ‘হাঁ’ বলে না দেয়া।

৮: পাত্রীর অভিভাবক বা পাত্রীরও উচিত, পাত্রের দ্বীনদারি দেখেই ‘হাঁ’ বলে না দেয়া। অবশ্য এমনটা খুব কমই হয়ে থাকে।

৯: বড়লোক ঘরের মেয়ে হলেই গরীব স্বামীর সাথে ঘরতে পারবে না এমন নয়। আবার গরীব ঘরের মেয়ে হলেই যে গরীব স্বামীর সাথে ঘর করতে পারবে, এমনও নয়। গরীব ঘরের অনেক মেয়েও স্বামীর ঘরে এসে ‘অন্যরূপী’ হয়ে যায়। তাদের চাহিদার শেষ থাকে না। শুরু হয় টানাপোড়েন।

১০: আমাদের মাদরাসায় পড়ে যাওয়া এক তালিবে ইলম। তাদের বাবা নেই। গরীব। তারা দুই ভাই মিলে বোনকে মাদরাসায় পড়িয়েছে। চূড়ান্ত পরীক্ষায় বেফাকে ঈর্ষণীয় ফল করেছে। শিক্ষকতা করতে গিয়ে, সর্বোচ্চ পর্যায়ের বড় বড় কিতাব পড়িয়েছে। তার যোগ্যতা দেখে যোগ্য যোগ্য আলিম-মুফতিরা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু পাত্রীর এককথা, হুজুর জামাইয়ের কাছে বিয়ে বসবে না। হুজুর জামাই ঠিকমত তার খরচ চালাতে পারবে না। শুধু তাই নয়, সে কোনও দাঁড়িওলার কাছেও বিয়ে বসবে না। গরীব ঘরেও না। দরকার হলে বিয়ে ছাড়াই থাকবে। ভাইয়েরা পড়ল ভীষণ বিপাকে। মাদরাসা পড়ুয়া সব মেয়েই হয়তো এমন নয়। এটা হয়তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে উদাহরণ হিশেবে উল্লেখযোগ্য।

১১: আজ জানলা দিয়ে ঝমঝমে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে ভাবছিলাম, মেয়েরা স্বামীর ঘরে গেলে, স্বামীর সামর্থের অতিরিক্ত চাহিদা দেখাবে না। বেয়াড়া বায়না ধরে স্বামী বেচারাকে বিপদে ফেলবে না, এই প্রসঙ্গে কোনও আয়াত পাওয়া যায় কি না। সরাসরি কোনও আয়াত বের করতে পারিনি। এসব হল অভিজ্ঞ ও যোগ্য আলিমের কাজ। আমাদের পক্ষে সম্ভবপর হওয়ার কথা নয়। আর দ্বীন ও দুনিয়ার সব কিছু কুরআনে থাকবেই এমনও নয়।

১২: এভাবে বের করতে না পেরে, কানা‘আত বা অল্পেতুষ্টি বিষয়ে আয়াত আছে কি না, সেটা খুঁজতে বসলাম। প্রথমেই মনে এল বিখ্যাত সেই দু‘আখানা,

رَبَّنَاۤ ءَاتِنَا فِی ٱلدُّنۡیَا حَسَنَةࣰ وَفِی ٱلۡـَٔاخِرَةِ حَسَنَةࣰ وَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ

হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দান করুন দুনিয়ায়ও কল্যাণ এবং আখিরাতেও কল্যাণ এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন (বাকারা ২০১)।

১৩: এই আয়াত মনে আসার কারণ কী? সামান্য যোগসূত্র আছে। আয়াতে বর্ণিত ‘হাসানাহ’ শব্দটাই সেই যোগসূত্র। মুফাসসিরীনে কেরাম এই শব্দের বিভিন্ন অর্থ বাতলে গেছেন,

১: দুনিয়া আখেরাতের নায-নেয়ামত। সুখ-শান্তি। অধিকাংশ মুফাসসিরীনের মত এটাই।

২: দুনিয়া ও আখিরাতের সুখ ও সুস্থ্যতা। পর্যাপ্ত ধন-সম্পদ।

- কাতাদাহ রহ.।

৩: দুনিয়ার হাসানাহ হল ‘ইলম’ মানে আল্লাহর কিতাবের সঠিক বুঝ, আখিরাতের হাসানাহ ‘জান্নাত। ইবাদত-বন্দেগীর তাওফীক।

- হাসান বসরী ও সুফিয়ান সাওরী রহ.।

৪: দুনিয়ার হাসানায় ‘সম্পদ। আখেরাতের হাসানায় ‘জান্নাত’।

- ইবনে যায়েদ ও সুদ্দী রহ.।

৫: দুনিয়ার হাসানা মানে আমালে নাফি‘ বা উপকারী আমল। ঈমান ও আনুগত্য। আখিরাতের হাসানাহ মানে আল্লাহর দীদার (দর্শন) লাভ, আল্লাহর যিকির, আল্লাহর মহব্বমাখা অন্তহীন সুখ-সাচ্ছন্দ্য লাভ

-ইমাম রাযি রহ.।

৬: দুনিয়ার হাসানাহ মানে (المَرْأةُ الصّالِحَةُ) নেককার স্ত্রী।

- আলি রা.।

৭: দুনিয়ার হাসানাহ মানে (الرِّزْقُ الواسِعُ) অফুরন্ত রুজি-রোজগার।

-মুকাতিল বিন সুলাইমান রহ.।

৮: দুনিয়ার হাসানাহ মানে, যা আছে তা নিয়ে তুষ্ট থাকা (القَناعَةُ بِالرِّزْقِ)। সার্বিক কল্যাণের তাওফীক। গুনাহমুক্তি। নেকসন্তান। ঈমান ও আমলের উপর অবিচলতা। আনুগত্যের মিষ্টতা। সুন্নাহর অনুসরণ। মানুষের প্রশংসা। সুস্থ্যতা। নিরাপত্তা। যোগ্যতা-দক্ষতা। শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়। সুহবতে সালেহীন বা নেককার ব্যক্তিবর্গের সংশ্রব।

-বাহরে মুহীত। ইমাম আবূ হাইয়ান রহ.।

৯: আখেরাতে হাসানাহ মানে, কেয়ামতের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে শান্তি ও নিরাপত্তা। কঠিন হিশেব থেকে মুক্তি। হিশেব সহজ হওয়া। হুর-গিলমান। নবীগনের সাহচর্য। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সাক্ষাত।

-বাহরে মুহীত। ইমাম আবূ হাইয়ান রহ.।

১০: আখেরাতে হাসানাহ মানে, ইখলাস ও মুক্তি। কানা‘আত ও শাফা‘আত। কবর থেকে ওঠার সাথে সাথে সুসংবাদ।

-ইমাম নাসাফী রহ.।

.

.

১৪: কানা‘আত বা অল্পেতুষ্টি আরেকটি আয়াতের পরোক্ষভাবও মাথায় এল,

إِنَّ ٱلۡأَبۡرَارَ لَفِی نَعِیم

নিশ্চিতভাবে জেনে রেখ, নেককারগণ অবশ্যই প্রভূত নেয়ামতের মধ্যে থাকবে (ইনফিতার ১৩)।

১৫: আয়াতে বর্ণিত ‘নাঈম’ শব্দটার অর্থ নেয়ামত। নেয়ামতের নির্দিষ্ট কোনও রূপ নেই। বান্দার দুনিয়া ও আখেরাতে উপকারে আসে, এমন সবকিছুই নেয়ামত বা নাঈম,

ক: নাঈম মানে কানা‘আত বা অল্পেতুষ্টি।

-ইমাম রাযি রহ.।

খ: নাঈম মানে অল্পেতুষ্টি ও তাওয়াক্কুল।

-ইমাম নীসাপূরী রহ.।

১৬: যাক, স্বামীর ঘরে স্ত্রীর ‘অল্পেতুষ্টি’ বিষয়ক আয়াত না পেলেও সমস্যা নেই। অন্য কেউ হয়তো পাবেন বা পাবেন না। নবীজি সা.-এর ঘরে উম্মুল মুমিনীনের মাঝেই তো প্রকৃত ‘কানা‘আতের’ আদর্শ আছে। সূরা আহযাবের ২৮ নাম্বার আয়াতে এই প্রসঙ্গে আলোচনা আছে।

১৭: এই ‘হাসানাহ’-এর দু‘আখানা অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক। এক দু‘আতেই প্রায় সবকিছু। নেকবিবির দু‘আ আছে। নেক সন্তানের দু‘আ আছে। কানা‘আতের দু‘আ আছে।

১৮: স্ত্রীর মধ্যে কানা‘আত না থাকলে, সংসারে সুখ আসে না। আযহাবের যুদ্ধের পর, মদীনার জীবনে কিছুটা সাচ্ছন্দ্য এল। প্রতিটি ঘরই পর্যাপ্ত পরিমাণে গনীমত লাভ করল। উম্মুল মুমিমীনের মনেও খেয়াল এল, এতদিন দারিদ্র্য-দৈন্যের মধ্য দিয়ে সংসার করেছি। এখন তো আগের মতো আর্থিক সমস্যা নেই। আমরাও চাইলে অন্যদের মতো আরেকটু ভালোভাবে থাকতে পারি। তারা নবীজির কাছে মনের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করল। তাদের প্রস্তাবে কোনও অভিযোগ ছিল না। এই প্রস্তাবটা শরীয়তের মানদণ্ডে দোষণীয়ও ছিল না। তবে একজন নবীর স্ত্রী হওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে, তাঁদের এভাবে চাহিদা পেশ করাকে শোভনীয় মনে করা হয়নি।

১৯: সাধারণ মানুষের জীবনযাপনপদ্ধতি আর একজন নবীর জীবনযাপনপদ্ধতি কিছুতেই এক হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা ওহী পাঠালেন,

یَـٰۤأَیُّهَا ٱلنَّبِیُّ قُل لِّأَزۡوَ ٰ⁠جِكَ إِن كُنتُنَّ تُرِدۡنَ ٱلۡحَیَوٰةَ ٱلدُّنۡیَا وَزِینَتَهَا فَتَعَالَیۡنَ أُمَتِّعۡكُنَّ وَأُسَرِّحۡكُنَّ سَرَاحا جَمِیلا

হে নবী! নিজ স্ত্রীদেরকে বলে দিন, তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার শোভা চাও, তবে এসো আমি তোমাদেরকে কিছু উপহার সামগ্রী দিয়ে সৌজন্যের সাথে বিদায় দেই (আহযাব ২৮)।

২০: আল্লাহু আকবার! কী ভয়ানক ব্যাপার। উম্মুল মুমিনীন কোনও অভিযোগ করেননি। তারপরও বিষয়টা আল্লাহর ইজ্জতে লেগেছে। যারা নবীর অবর্তমানে নবীওলা কাজে ব্যস্ত (আলিম বা অনালিম), তাদের বিবিদের জন্য কি শোভনীয় হবে, দ্বীনি কাজে মশগুল থাকা স্বামীকে টাকার পেরেশান করা? যারা বলে ‘আলিম’ বা হুজুর জামাইয়ের কাছে বিয়ে বসব না, কারণ তাদের কাছে টাকাপয়সা নেই, তাদের তাওবা করা উচিত।

২১: গরীব স্বামীর ঘরে কষ্ট ও কানাআতের সাথে ঘর করলে কী হবে? উম্মুল মুমিনীনগণকে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

وَإِن كُنتُنَّ تُرِدۡنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَٱلدَّارَ ٱلۡـَٔاخِرَةَ فَإِنَّ ٱللَّهَ أَعَدَّ لِلۡمُحۡسِنَـٰتِ مِنكُنَّ أَجۡرًا عَظِیما

আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখেরাতের নিবাস কামনা কর, তবে নিশ্চিতভাবে জেনে রেখ, আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল, সেই নারীদের জন্য মহা প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন (আহযাব ২৯)।

২২: আমরা বলছি না, নিজ থেকে যেছে গরীব স্বামী বেছে নিতে। এমন করতে পারলে তো সোনায় সোহাগা। আমরা বলছি, বিয়ের পর যদি দেখা যায় স্বামীর অর্থিক অবস্থা দুর্বল, তখন উম্মুল মুমিনীনগনের আদর্শ গ্রহণ করার কথা।

২৩: ভাগ্যে গরীব জুটে গেলে, তার ঘরে কানা‘আতের সাথে থেকে, আল্লাহর প্রস্তুত করা ‘আজরে আযীম’ বা বিরাট প্রতিদানের মালিক হওয়া কি উত্তম নয়?

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□সুতরাহ! □□

-

খুশু-খুযু সলাতের প্রাণ। খুশু-খুযু মানে গভীর মনোযোগ বা অনুধ্যান। আমাদের উচিত, এমনভাবে সলাত আদায় করা, যাতে খুশু-খুযুতে ব্যঘাত না ঘটে। নবীজির মতো খুশু-খুযু আর কার হতে পারে? তারপরও নবীজি নিজে সুতরা ব্যবহার করতেন। উম্মতের নামায যেন নির্বিঘœ আর নিরুপদ্রব হয়, এজন্য তিনি নামাযীর আগে দিয়ে কাউকে হাঁটাচলা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করে গেছেন। সামনে হাঁটাহাঁটি করলে, মুসল্লির মনোযাগে ব্যঘাত ঘটতে পারে। তা ছাড়া নামাযের আলাদা একটা সম্মান আছে। নামাযীর আশেপাশে ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করা দরকার। যে কোনও ইবাদতের জন্যই পরিবেশ লাগে। গভীর রাতে নিরব সময়ের নামায আর কোলাহলময় সময়ের নামায গুণ ও মানে অবশ্যই তফাৎ থাকবে।

সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে স্বাভাবিকভাবেই মনোযোগে ঘাটতি আসবে। কেরাত থেকে মন ছুটে যাবে। সামনে দিয়ে কে হেঁটে যাচ্ছে, তা জানার জন্য কৌতূহলি মন আকুলিবিকুলি করে উঠবে। মনকে জোর করে বশে রাখলেও, নামায আর আগের মতো ছেদহীন হবে না। হয়তো এসব দিক খেয়াল করেই নবীজি সা. বলে গেছেন,

لو يَعْلَمُ المارُّ بيْنَ يَدَيِ المُصَلِّي ماذا عليه، لَكانَ أنْ يَقِفَ أرْبَعِينَ خَيْرًا له مِن أنْ يَمُرَّ بيْنَ يَدَيْهِ

একজন নামাযীর সামনে দিয়ে (ইচ্ছাকৃতভাবে) হেঁটে যাওয়ার ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে জানতে পারলে, চল্লিশ দিন (মাস বা বছর) দাঁড়িয়ে থাকত। তবুও মুসল্লির সামনে দিয়ে হেঁটে যেত না (আবু জুহাইম রা. বুখারী ৫১০)।

.

নবীজি উম্মতের সলাতকে সুন্দর ও নিমগ্ন করে তুলতে, অত্যন্ত চমৎকার এক সুন্নত উপহার দিয়ে গেছেন। উম্মতকে সামনে ‘সুতরা’ দিয়ে নামায আদায় করতে বলে গেছেন। সুতরা মানে আবরণ বা অন্তরায়। সিজদা দেয়ার স্থান ঘেঁষে লাঠি বা দ-সদৃশ কিছু একটা পুঁতে দেয়া। সুতরার মাধ্যমে মোটাদাগে কয়েকটি উপকার,

ক: মুসল্লী মনোযোগ দিয়ে সলাত আদায় করতে পারবে।

খ: অন্য মুসল্লী নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারবে।

নবীজি নামাযীর আগে দিয়ে হাঁটত নিষেধ করে ক্ষান্ত হননি। সুতরার সুন্নাত জারি করে সমাধানও দিয়ে গেছেন। মুসল্লী ও চলাচলকারী উভয়ের স্বার্থ রক্ষিত হল। নবীজি বলেছেন,

إذا صلّى أحدُكم فليصلِّ إلى سُترةٍ وليدنُ منها

তোমরা সামনে ‘সুতরা’ রেখে, তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে নামায পড়বে (আবু সায়ীদ খুদরি রা. আবু দাউদ ৬৯৭)।

গ: সামনে দিয়ে কাউকে অতিক্রম করতে দিবে না,

ولا يدَعْ أحدًا يمُرُّ بينَ يدَيْهِ

সামনে দিয়ে কাউকে যেতে দিবে না (আবু সায়ীদ রা. ইবনে হিব্বান ২৩৭২)।

ঘ: সামনে কিছু একটা রাখতেই হবে,

اسْتتِروا في صلاتكُم ولو بسهمٍ

তোমরা সলাত আদায়ের সময়, অন্তত সামনে একটা তীর রেখে হলেও আড়াল সৃষ্টি করো (রবী বিন সাবুরাহ। জামে‘ সগীর ৯৬২)।

ঙ: সামনে দিয়ে কাউকে যেতে দিবে না। নামাযীর সামনে দিয়ে কেউ গেলে, তাক শয়তান আখ্যায়িত করা হয়েছে,

لا يقطعُ الشيطانُ عليه صلاتَه

শয়তান যেন তার সলাতে ব্যাঘাত না ঘটায় (সাহল বিন হাসমাহ। আবু দাউদ ৬৯৫)।

.

সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে সুতরার সুন্নাত পালন করতেন। আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বর্ণনা করেছেন,

‘‘এক জুমার দিন আবু সাঈদ খুদরীকে দেখলাম সামনে সুতরা রেখে নামায পড়ছেন। একজন যুবক সামনে দিয়ে যেতে উদ্যত হলে, আবু সাঈদ তাকে ধাক্কা দিয়ে হটিয়ে দিলেন। যুবকটি এদিক-সেদিক তাকিয়ে আর কোনও পথ না দেখে, আবার আগের জায়গা দিয়ে অতিক্রম করতে গেল। আবু সাঈদ এবার যুবকের বুকে আগের চেয়েও জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। যুবকটি রেগেমেগে আবু সাঈদকে গালমন্দ করে, গভর্নর মারওয়ান বিন হাকামের কাছে গিয়ে নালিশ করল। নামাজ শেষ করে আবু সাঈদও মারওয়ানের দরবারে হাজির হলেন। মারওয়ান বিস্তারিত ঘটনা জানতে চাইলেন। আবু সাঈদ রা. বললেন, আমি আল্লাহর রাসূলকে বলতে শুনেছি’’,

إذا صَلّى أحَدُكُمْ إلى شيءٍ يَسْتُرُهُ مِنَ النّاسِ فأرادَ أحَدٌ أنْ يَجْتازَ بيْنَ يَدَيْهِ، فَلْيَدْفَعْهُ فإنْ أبى فَلْيُقاتِلْهُ فإنَّما هو شيطانٌ.

সামনে সুতরা রেখে নামায পড়ার সময়, সামনে দিয়ে কেউ অতিক্রম করতে চাইলে, তাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দেবে। মানতে না চাইলে অপেক্ষাকৃত জোরে ধাক্কা দেবে। কারণ এই লোক মানুষ হলেও স্বভাবে সাক্ষাত শয়তান (বুখারী ৫০৯)।

ক: ওলামায়ে কেরামের মতে ধাক্কা দেয়াটা ওয়াজিব বা আবশ্যক কিছু নয়। কোনওভাবে বাধা সৃষ্টি করলেই হবে।

খ: সবচেয়ে ভালো হয়, কাউকে আসতে দেখলে সামনের দিকে লম্বালম্বি হাত বাড়িয়ে দেবে। তাহলেই আশা করি কাজ হয়ে যাবে।

.

নবীজির বিভিন্ন সময়ের নামায খেয়াল করলেও দেখা যায়, তিনি সযতেœ সুতরা ব্যবহার করতেন,

أنَّ النبيَّ صَلّى اللهُ عليه وسلَّمَ كانَ يُرْكَزُ له الحَرْبَةُ فيُصَلِّي إلَيْها.

নবীজির সামনে বর্শা পুঁতে রাখা হত। তিনি সেটাকে সুতরা বানিয়ে নামায আদায় করতেন (আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা.। বুখারী ৪৯৮)।

আরেক হাদীসে আছে

أنَّ النبيَّ ﷺ كانَ تُرْكَزُ الحَرْبَةُ قُدّامَهُ يَومَ الفِطْرِ والنَّحْرِ، ثُمَّ يُصَلِّي

ঈদুল ফিতর ও আযহার দিন নবীজির সামনে বর্শা পুঁতে রাখা হত। নবীজি সুতরা সামনে রেখে ঈদের নামায পড়াতেন (বুখারী ৯৭২)।

.

সফরে এলেও সুতরা ব্যবহার করতেন। উন্মুক্ত প্রান্তরে সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে যাওয়ার আশংকা না থাকলেও সুতরা ব্যাবহার করতেন,

رَأَيْتُ رَسولَ اللَّهِ ﷺ بالأبْطَحِ، فَجاءَهُ بلالٌ فَآذَنَهُ بالصَّلاةِ ثُمَّ خَرَجَ بلالٌ بالعَنَزَةِ حتّى رَكَزَها بيْنَ يَدَيْ رَسولِ اللَّهِ ﷺ بالأبْطَحِ، وأَقامَ الصَّلاةَ.

আল্লাহর রাসূল সা.-কে মক্কার বাইরে ‘আবতাহ’ নামক স্থানে দেখতে পেলাম। বেলাল এসে নবীজিকে নামাযের সময় হওয়ার সংবাদ দেয়ার পর, একটা লম্বা লাঠি নবীজির সামনে পুঁতে দিল। নবীজি লাঠিটাকে সুতরা বানিয়ে নামায পড়ালেন (আবু জুহাইফা রা.। বুখারী ৬৩৩)।

.

মসজিদের খুঁটি, মসজিদের দেয়ালও সুতরা। সাহাবায়ে কেরাম একাকী নামায পড়ার সময়, মসজিদে নববীর খুঁটিকে সুতরা বানাতেন,

كانَ المُؤَذِّنُ إذا أذَّنَ قامَ ناسٌ مِن أصْحابِ النبيِّ ﷺ يَبْتَدِرُونَ السَّوارِيَ، حتّى يَخْرُجَ النبيُّ ﷺ وهُمْ كَذلكَ، يُصَلُّونَ الرَّكْعَتَيْنِ قَبْلَ المَغْرِبِ، ولَمْ يَكُنْ بيْنَ الأذانِ والإِقامَةِ شيءٌ.

মুয়াজ্জিন আযান দিলে, কিছু সাহাবী দ্রুত মসজিদের খুঁটিসমূহের দিকে চলে যেতেন। মাগরিবের আগে, নবীজি হুজরা থেকে বের হতে হতে তারা দুই রাকাত হালকা নামায পড়ে নিতেন। মাগরিবের আযান ও ইকামতের মাঝে খুব বেশি সময় থাকত না (আনাস বিন মালিক রা.। বুখারি ৬২৫)।

.

সুতরা মুসল্লীর কতটুকু সামনে থাকবে? বেশি দূরে দিলে, জায়গা না থাকলে, চলাচলে মানুষের কষ্ট হতে পারে। সিজদার জায়গা ঘেঁষে সুতরা দেয়া সুন্নাত,

كانَ بيْنَ مُصَلّى رَسولِ اللَّهِ ﷺ وبيْنَ الجِدارِ مَمَرُّ الشّاةِ.

আল্লাহর রাসূলের মুসাল্লা (নামাযের স্থান। এখানে উদ্দেশ্য সিজদার স্থান) ও দেয়ালের মাঝে একটি ছাগল পরিমাণ জায়গা খালি থাকত (সাহল বিন সা‘দ রা.। বুখারী ৪৯৬)।

নবীজি দেয়ালের কাছ ঘেঁষে দাঁড়াতেন। সিজদার স্থানের সামান্য আগে সুতরা দিতেন। সুতরার সামনে থেকে দেয়াল পর্যন্ত কিছু জায়গা খালি থাকত। সাহাবায়ে কেরাম ওখান দিয়ে প্রয়োজনে এপাশ-ওপাশ যেতে পারতেন। সুতরার ক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয় লক্ষ্য রাখা জরুরী,

১: সুতরা যতটা সম্ভব কাছাকাছি পোঁতা। নবীজির উক্তি (وَلْيَدْنُ مِنها) মুসল্লী যেন সুতরার কাছকাছি দাঁড়ায়।

২: সুতরার সামনে লোক চলাচল করতে পারে পরিমাণ জায়গা খালি রাখা। পা থেকে সুতরা তিনগজ বা সামান্য দূরত্বে হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইবনে উমার রা. নবীজির সুন্নাতের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করতে চাইতেন,

أنَّ عَبْدَ اللَّهِ بنَ عُمَرَ، كانَ إذا دَخَلَ الكَعْبَةَ مَشى قِبَلَ وجْهِهِ حِينَ يَدْخُلُ، وجَعَلَ البابَ قِبَلَ ظَهْرِهِ، فَمَشى حتّى يَكونَ بيْنَهُ وبيْنَ الجِدارِ الذي قِبَلَ وجْهِهِ قَرِيبًا مِن ثَلاثَةِ أذْرُعٍ، صَلّى يَتَوَخّى المَكانَ الذي أخْبَرَهُ به بلالٌ، أنَّ النبيَّ ﷺ صَلّى فِيهِ، قالَ: وليسَ على أحَدِنا بَأْسٌ إنْ صَلّى في أيِّ نَواحِي البَيْتِ شاءَ.

আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. কা‘বায় প্রবেশ করে, দরজা পেছনে রেখে, সামনের দেয়াল থেকে তিনগজ দূরত্বে নামাযে দাঁড়াতেন। তিনি বেলালের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলেন, নবীজি কা‘বার অভ্যন্তরে কোথায় দাঁড়িয়ে নামায পড়েছেন। তিনিও হুবহু সেই স্থানে নামযে দাঁড়িয়েছেন। তবে ইবনে উমারের মতে, কা‘বার যে কোনও স্থানে (যে কোনও দিকে মুখ করে) নামায পড়তে পারবে (বুখারী ৫০৬)।

৩: কেউ সুতরা না নিয়ে নামায পড়লে, তার তিনগজ সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে কোনও গুনাহ হবে না।

৪: একাকী নামায পড়লে সুতরা দিবে। জামাতে নামায পড়লে, ইমামের সামনে রাখা সুতরাই পুরো জামাতের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে,

أَقْبَلْتُ راكِبًا على حِمارٍ أتانٍ، وأَنا يَومَئذٍ قدْ ناهَزْتُ الِاحْتِلامَ، ورَسولُ اللَّهِ ﷺ يُصَلِّي بالنّاسِ بمِنًى إلى غيرِ جِدارٍ، فَمَرَرْتُ بيْنَ يَدَيْ بَعْضِ الصَّفِّ فَنَزَلْتُ، وأَرْسَلْتُ الأتانَ تَرْتَعُ، ودَخَلْتُ في الصَّفِّ، فَلَمْ يُنْكِرْ ذلكَ عَلَيَّ أحَدٌ

নবীজি তখন মিনাপ্রান্তরে। দেয়াল বা অন্য কিছুর সুতরা ছাড়াই নামায পড়াচ্ছিলেন। আমি তখন বয়ঃপ্রাপ্তির দ্বারপ্রান্তে। আমি উটনির পিঠে সওয়ার হয়ে কাতারের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে, উটনিকে চরে ঘাসপাতা খেতে দিলাম। কেউ কিছু বললেন না (ইবনে আব্বাস রা. বুখারী ৪৯৩)।

ক: ইমাম সুতরা ছাড়াও নামায পড়াতে পারবেন। জামাত চলাকালে প্রয়োজনে অন্য মুসল্লীদের সামনে হাঁটা যাবে। ইমামের সুতরাই মুক্তাদির সুতরা বলে বিবেচিত হবে।

খ: ছোটবেলা ইলম শিখে, বড়বেলায় আমলা করা যাবে।

৫: সুতরা দেয়ার মত কিছু না পেলে?

إذا صلّى أحدُكم فليجعلْ تِلقاءَ وجهِه شيئًا، فإن لم يجدْ فليَنصِبْ عصاه، فإن لم يكن معه عصا فليَخُطَّ خطًّا ولا يضرُّه من مرَّ بين يدَيه

তোমরা সলাত আদায় করার সময় সামনে কিছু রাখবে। কিছু না পেলে, নিজের লাঠি পুঁতে রাখবে। সাথে লাঠি না থাকলে, একটা ‘দাগ’ টেনে রাখবে। রেখার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে কোনও ক্ষতি নেই (আবু হুরায়রা রা. আবু দাউদ ৬৮৯)।

৬: সুতরার উচ্চতা কেমন হবে?

إذا وضَعَ أحَدُكُمْ بيْنَ يَدَيْهِ مِثْلَ مُؤْخِرَةِ الرَّحْلِ فَلْيُصَلِّ، ولا يُبالِ مَن مَرَّ وراءَ ذلكَ.

জিনদ-ের মতো কিছু সামনে রেখে নামায পড়লে, তোমাদের সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও কানও সমস্যা নেই (তলহা বিন ওবাইদুল্লাহ রা. মুসলিম ৪৯৯)।

ক: উটের পিঠে বসার জন্য জিন লাগানো হয়। জিনের শেষাংশে আরোহী হেলান দেয়ার সুবিধার্থে একটা দ- বা কাষ্ঠফলক থাকে।

খ: জিনদ-ের উচ্চতা কখনো কম কখনো বেশি হয়। সাধারণত বাহুর হাড় পরিমাণ হয়। বাহুর হাড় একগজের দুই তৃতীয়াংশ। মোটামুটি একগজ উচ্চতার হলেই হবে।

খ: সুতরা তীর বা বর্শার মতো চিকনও হতে পারবে। দেয়াল, খুঁটি বা গাছের মতো পুরুও হতে পারবে।

৭: সুতরা দেয়ার হুকুম কী? মুসল্লিকে সুতরা দিতেই হবে? সুতরা দেয়া স্বাভাবিক অবস্থায় মুস্তাহাব। কেউ কেউ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ বলেছেন। আবার কেউ ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াজিবও বলেছেন। মানুষ চলাচলপূর্ণ স্থানে নামাযে দাঁড়ালে, সুতরা দেয়া ওয়াজিব।

৮: ফরয, সুন্নত সব নামাযেই সুতরা দেবে।

৯: এক হাদীসে আছে,

فإنَّه يَقْطَعُ صَلاتَهُ الحِمارُ، والْمَرْأَةُ، والْكَلْبُ الأسْوَدُ

গাধা, নারী, কালোকুকুর সামনে দিয়ে গেলে, নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে (আবু যার গিফারী রা.। মুসলিম ৫১০)।

১০: এসব সামনে দিয়ে গেলে কি নামায ভেঙে যাবে? জি¦ না। ভাঙবে না। হাদীসে আছে, নবীজি রাতে নামায পড়ার সময় আম্মাজান আয়েশা রা. তার আগে দিয়ে শুয়ে থাকতেন।

.

কিছু কথা:

১: অনেক সময় দেখা যায়, মসজিদে প্রবেশ করে, কোনও বাছ-বিচার ছাড়াই নামাযে দাঁড়িয়ে যায়। একটু চিন্তা করা উচিত, আমি যেখানে দাঁড়াচ্ছি, অন্য মুসল্লীর কোনও সমস্যা হবে কি না। চেষ্টা করা মসজিদের খুঁটি সামনে রেখে দাঁড়াতে। সাহাবায়ে কেরাম তাই করতেন। খুঁটি ধরার জন্য তারা রীতিমতো প্রতিযোগিতা করতেন। তারমানে তারা সুতরাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। মসজিদে সুন্নত পড়ার জন্য, তারা মসজিদে নববীর খুঁটিকে সুতরা বানাতেন। সুতরা মানে শুধু সামনে কিছু একটা পুঁতে রাখাই নয়, মসজিদের দেয়াল বা স্তম্ভও সুতরা হতে পারে।

২: মাঝেমধ্যে দেখা যায়, পেছনের কাতারে জামাতের একেবারে শেষে এসে ‘মাসবুক’ হয়েছে। সামনের কাতারের মুসল্লীগণ সুন্নত পড়ে বেরোবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। এদিকে এখনো মাসবুকের ছুটে যাওয়া রাকাত শেষ হয়নি। কেউ কেউ তখন এত ধীরে ধীরে নামায পড়েন, মনে হয় আজ আর তার নামায শেষ হবে না। লোকজন বিরক্ত হয়ে তাকে ডিঙ্গিয়ে চলে যেতে শুরু করে। কতক্ষণ অপেক্ষ করবে? পরিস্থিতি এমন হলে, মাসবুক ব্যক্তি নামাযকে একটু খাটো করাই উত্তম। মনে রুকু-সিজদার তাসবীহ কমিয়ে পড়া। তিনবারের স্থানে একবার পড়া। শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ-দোয়ায়ে মাসুরা একদম অতি ধীরে না পড়া।

৩: মাঝেমধ্যে এমনও হয়, সামনের জন সুন্নত পড়ে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু পেছনের মুসল্লী নফলের নিয়্যাত বেঁধে ফেলেছেন। পেছনের কাতারে থাকা মুসল্লীর খেয়াল রাখা উচিত, আমি নফলের নিয়্যাত বাঁধলে সামনে ব্যক্তি আটকা পড়ে যাবেন কি না। সরে দাঁড়ানো সম্ভব হলে তাই করা উত্তম।

৪: কেউ কেউ আছেন, সামনে কেউ তার নামায শেষ করার অপেক্ষায় বসে বা দাঁড়িয়ে থাকলে, তার নামাযের গতি ধীরতর হয়ে যায়। কখনো কখনো মনে হয়, তারা সামনের মানুষকে দাঁড় করিয়ে রাখতে আনন্দ পান। অথবা নিজেকে অতি মনোযোগী নামাযী প্রমাণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে দু’টি মারাত্মক গুনাহ হয়,

ক: রিয়া বা লোক দেখানো।

খ: ঈযায়ে মুসলিম। মুসলমানকে কষ্ট দেয়া।

গ: তাছাড়া নামাযরত থেকে ‘খারেজী’ বিষয় নিয়ে ভাবনার কারণে, নামাযও হালকা হয়ে যায়।

৫: বাড়িঘরে নামায পড়ার সময়ও, সামনে দিয়ে কারো হাঁটার সম্ভাবনা থাকলে, সামনে সুতরা রেখে দেয়া জরুরী।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□কিতাবুল আখিরাত!□□

(০৭-০৭-১৯)

-

১: কুরআনের নাম কী? কুরআন কারীমের অনেক নাম। কুরআনকে কিতাবুল আকায়েদ বলা যায়। কিতাবুত তাওহীদ বলা যায়। আরও বলা যায় কিতাবুল আখিরাহ। কুরআন কারীমে ঘুরেফিরেই আখিরাতের আলোচনা। কুরআনের সব আলোচনাই শেষমেষ গিয়ে ঠেকে আখিরাতে।

২: বায়তুল্লাহ। কা‘বার চারপাশে ঘুরে হাজারো আল্লাহপ্রেমিক তাওয়াফ করছে। নানা রঙের। নানা বর্ণের। ধনী। গরীব। একজন কালো মানুষও সবার সাথে তাওয়াফ করছে। আপনমনে যিকির করছে। শাদা ছড়ি ঠুকঠুক করে ভীড়ের বাইরে থেকে ধীরে ধীরে প্রদক্ষিণ করছে। গায়ে-গতরে অন্য অন্য আর দশজন আফ্রিকানের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অতি শীর্ণ দেহকাঠামো। জীর্ণ পোশাক-পরিচ্ছদ। চোখে কালো ঠুলি। পায়ের পাতা আর গোড়ালি ফেটে ফালাফালা।

৩: অন্ধ মানুষ কতদূর থেকে হজ্জ করতে এসেছে। আশপাশের লোকজন মায়াভরা দৃষ্টিতে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। মানুষটাকে ঠেকে ঠেকে এগুতে দেখে, এক আরবের দিলে দরদ জেগে উঠল। কাছে গিয়ে মানুষটার কনুই ধরে সাহায্য করতে চাইল। অন্ধ মানুষটা সাহায্যকারীকে চমকে দিয়ে তিলাওয়াত করল,

وَأَذِّن فِی ٱلنَّاسِ بِٱلۡحَجِّ یَأۡتُوكَ رِجَالا وَعَلَىٰ كُلِّ ضَامِر یَأۡتِینَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِیق

এবং মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পদযোগে এবং দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রমকারী উটের পিঠে সওয়ার হয়ে, যেগুলো (দীর্ঘ সফরের কারণে) রোগা হয়ে গেছে (হাজ্জ ২৭)।

৪: তিলাওয়াত শেষ করে আফ্রিকান একসেন্টে আরবীতে বলল,

-আরব ভাই! জাযাকাল্লাহু খাইরান। আমার সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আল্লাহর দাওয়াত সেই সুদূর ‘বেনিন’ থেকে একদূর আসতে পেরেছি, বাকি কাজও আল্লাহর রহমতে করতে পারব।

৫: সাহায্যকারী আরব হাত গুটিয়ে নিলেন। কালো মানুষটার পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করলেন। বোঝা গেল, এই লোকের আচরণ তাকে অবাক করেছে। মুগ্ধও করেছে হয়তোবা। একটু পর আরবটি ভীষণ চমকে উঠল কালো মানুষটির একটি কথা শুনে। মানুষটা অনুচ্চ স্বরে ভাঙা ভাঙা আরবীতে স্বগতোক্তি করলেন,

-আরব ভাই! আপনি আমার সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। আপনাকে আমি দেখতে পারছি না। তবে দু‘আ করছি। ইন শা আল্লাহ জান্নাতে আমি আপনাকে দেখব।

৬: পাক্কা মুমিনের কথা। মুমিনের সবকিছুই হবে আখেরাতকে ঘিরে। দুনিয়ার অবস্থান সাময়িকের। ক্ষণিকের। কালো মানুষটা কী অনায়াসে আখিরাতকে হাজির করে ফেললেন! কুরআন কারীমের মূল শিক্ষা তো এটাই। আখিরাতই হবে মুমিনের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। আখিরাতকে ঘিরেই মুমিনের যাবতীয় কার্যক্রম আবর্তিত হবে।

৭: কালো মানুষটা নিশ্চয়ই সবসময় আখিরাতের চিন্তায় বিভোর থাকে। নইলে এভাবে চট করে ছোট্ট প্রসঙ্গ থেকে একদৌড়ে আখেরাতে চলে যাওয়া সহজ কথা নয়। প্রকৃত জীবন তো আখেরাতেই,

وَمَا هَـٰذِهِ ٱلۡحَیَوٰةُ ٱلدُّنۡیَاۤ إِلَّا لَهۡوࣱ وَلَعِبࣱۚ وَإِنَّ ٱلدَّارَ ٱلۡـَٔاخِرَةَ لَهِیَ ٱلۡحَیَوَانُۚ لَوۡ كَانُوا۟ یَعۡلَمُونَ

এই পার্থিব জীবন খেলাধূলা ছাড়া কিছুই নয়। বস্তুত আখেরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত (আনকাবূত ৬৪)।

৮: আমার মনে কি ঘড়ির কাঁটার মতো সবসময় আখিরাত ‘টিকটিক’ করে ঘোরে? আমার মনের কম্পাসের কাঁটা কি হরওয়াক্ত আখিরাতের দিকনির্দেষ করে? ব্যতিক্রম হলে এখনো সচেতন হওয়ার সুযোগ আছে।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

ইবলীসেরও অধম!

-

১: আজকালের মুলহিদরা (নাস্তিক) ইবলীস শয়তানেরও অধম। তাদের কথাবার্তা, তাদের চিন্তাভাবনা শয়তানকেও লজ্জায় ফেলে দেয়। ইবলীস একটি হুকুমে আল্লাহর অবাধ্যতা করলেও, আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করত। এমনকি আল্লাহর বড়ত্ব আর মহত্বের আকীদাও পোষণ করত। কাজেকর্মে আল্লাহর ইজ্জতের (فَبِعِزَّتِكَ) শপথ করত। সূরা সোয়াদ ৮২।

২: বর্তমানের মুলহিদরা আল্লাহকে গালি দেয়। আল্লাহর দ্বীনকে গালি দেয়। অথচ এমন কাজ ইবলীসও করেনি। এদের মধ্যে সেই প্রাচীন রোগ দেখা দিয়েছে। নূহ আ. অবাক হয়ে তার কওমকে প্রশ্ন করেছিলেন,

مَّا لَكُمۡ لَا تَرۡجُونَ لِلَّهِ وَقَارا

তোমাদের কী হল, তোমরা আল্লাহর বড়ত্বকে ভয় করছ না (নূহ ১৩)।

৩: এখন ইসলামবিরোধী যেসব চিন্তা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ করেছে, তার সবগুলোর ধরণই আগের যুগের জাতিসমূহের মধ্যে ছিল। কুরআন কারীমে ফিরে আসা ছাড়া গতি নেই। কুরআনের ছোঁয়া ছাড়া বাঁচার এই মহাদুর্যোগ থেকে বাঁচার উপায় নেই।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ইহুদি তাকবীর!□□

-

১: বাংলায় একটা প্রবাদবাক্য আছে ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’। এই বাক্যটি প্রথম পড়েছিলাম বোধহয় পাক্ষিক শৈলী পত্রিকায়। গুণে মানে অত্যন্ত উঁচুদরের সাহিত্য পত্রিকা ছিল সেটি । অনেক স্মৃতি আছে পত্রিকাটি নিয়ে। বাক্যটির মানে হল, আমাকে যে ‘বধ’ করবে, সে আমার গোয়ালেই আমার অগোচরে বেড়ে উঠছে।

২: প্রাত্যহিক জীবনে, আমরা ভাত খাাই। পানি পান করি। নিঃশ্বাস গ্রহণ করি, ছাড়ি। দেখি। শুনি। হাঁটাচলা করি। কাজ করি। এগুলো আমরা অভ্যস্ত রীতিতে নিয়মিত করি। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এসব কাজের পাশাপাশি আমরা নিয়মিত কিছু চিন্তাও অভ্যস্ত রীতিতে করে থাকি। সংসারের চিন্তা করি। বিবি-বাচ্চার চিন্তা করি। রুজি-রোজগারের চিন্তা করি।

৩: কুদস-ফিলিস্তীন, শাম-মুসলিম বিশ্ব নিয়ে ভাবনাও একজন মুসলিমের প্রাত্যহিক জীবন ও চিন্তার অংশ হওয়া উচিত। রাব্বে কারীমের অশেষ করুণায় এই তাওফীক অধমের কিছুটা হলেও নসীব হয়। গত কয়েকদিন ধরে ইসরায়েলে তুমুল বিক্ষোভ চলছে।

৪: ইহুদিদের বারো গোত্রের একটির বাস ছিল ইথিওপিয়ায়। আমাদের গল্প ‘রেসিডেন্সিয়াল গার্লসস্কুল ইন হারার’ লেখার প্রস্তুতিপর্বে এদের সম্পর্ক বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়েছিল। গল্পটাতেও তাদের সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু কথা এসেছে। ইসরায়েল গঠিত হওয়ার পর থেকেই সারাবিশে^ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বারোটি গোত্রকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় শুরু হয়। তার ধারাবাহিকতায় নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ইথিওপিয়া থেকেও ‘ফালাশা’ ইহুদিদের ইসরায়েলে নিয়ে আসা হয়।

৫: ‘ফালাশা’ ইহুদিদের গায়ের রঙ কালো। এজন্য ইউরোপ ও অন্য জায়গা থেকে আসা শাদা চামড়ার ইহুদিরা ‘ফালাশাদেরকে’ অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে। রাষ্ট্রীয়ভাবেও ফালাশারা অবহেলার শিকার। এজন্য তাদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলতেই থাকে। কয়েকদিন আগে পুলিশের গুলিতে এক ফালাশা ইহুদি নিহত হয়েছে। তার জের ধরে ফালাশারা তুমুল হট্টগোল মাচিয়ে তুলেছে। ভাংচুর-বিশৃঙ্খলার রাজত্ব কায়েম করেছে তারা। দেখার বিষয় হল, এতকিছুর পরও পুলিশ এখন আর কারো গায়ে হাত তুলছে না।

৬: মজার বিষয় হল, ফালাশা ইহুদিরা শাদা চামড়ার প্রভুদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাতে গিয়ে, মুজাহিদীনের মতো ‘তাকবীরধ্বনি’ করছে। একজন বলছে,

তাকবীইইইর!

বাকিরা সবাই গলা ফাটিয়ে বলছে,

আল্লাহু আকবার!

ভিডিওটা হঠাৎ করে কেউ দেখলে ভাবলে কোনও মুসলিম দেশের যুবকরা বুঝি রাস্তায় এসেছে। তবে খুব বেশি দেরিও নেই। সত্যিকারে ‘তাকবীরধারীরাই’ এখানে তাকবীর দেবে। ইন শা আল্লাহ।

৭: যে কোনও ভাবনা বা কাজকে কুরআন কারীমে নিয়ে আসার প্রবণতা থেকেই মাথায় এল সূরা হাশরের আয়াতখানা,

ক: আপনি তাদেরকে একতাবদ্ধ মনে করেন (تَحۡسَبُهُمۡ جَمِیعا)।

খ: অথচ তাদের হৃদয়গুলো বিক্ষিপ্ত (وَقُلُوبُهُمۡ شَتَّىٰۚ)।

৮: আল্লাহ তা‘আলার আজীব এক সুন্নাহ বা রীতি হল, তিনি শক্তিমানের শক্তির জায়গা থেকেই তার পতনের সূচনা করেন। দাম্ভিকের দম্ভই হয়ে ওঠে পতনের মূল। আমেরিকার অস্ত্র বা অর্থনীতিই হয়ে উঠবে তার পতনের মূল। এমনকি মুজাহিদের ক্ষমতা বা সামর্থও কখনো কখনো তার সাময়িক পরাজয়ের কারণ হয়ে যেতে পারে। হুনায়নের যুদ্ধ তার একটি উদাহরণ হতে পারে।

৯: সূরা হাশরে ইহুদিদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা শেষকথা বলে দিয়েছেন। তারা যতই একত্র হোক, তাদের মধ্যে হাজারও ফাটল থাকবেই। এবং তাদের ‘একত্র’ হওয়াটাই তাদের পতনের সূচনা করবে।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□আসমানি মাইর!□□

-

কওমে লূত সমকামিতার ব্যাপারে ঐক্যমত্যে পৌঁছেছিল। অল্পকিছু হয়তো ব্যতিক্রম ছিল। বর্তমানের আলোকে বিবেচনা করলে,

১: গণতান্ত্রিক: তাদেরকে বাধা দেয়ার অধিকার লূতের নেই। কারণ সমকামী স্বভাবের লোকেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সর্বাধিকের মতামতের ভিত্তিতেই সমাজ-দেশ চলবে। একজনের কথায় নয়। গুটিকয়েকের মতামতের ভিত্তিতে দেশ ও দশ চলতে পারে না।

২: লিব্যারাল: মানুষ যে যার কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীন। আরেকজন তার ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে? প্রত্যেকেরই নিজের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করার অধিকার রয়েছে। অন্যের অধিকার ক্ষুন্ন না করে, যা-খুশি করতে পারবে। দু’জনে পারস্পরিক সম্মতিক্রমে সমকামে লিপ্ত হলে, অন্যের সেখানে নাক গলানোর অধিকার আসে কীভাবে?

৩: আধুনিকমনা/এনলাইডেট: এদের জিনগত সমস্যা আছে। তারা যেহেতু নারীর প্রতি আকর্ষণ বোধ করে না, তাই স্বভাব-প্রকৃতির বিরুদ্ধে জোর খাটানোর কী দরকার? তাদেরকে তাদের মতো করে চলতে দিলেই হয়।

৪: অন্ধ জামী/মাদখালী: উলিল আমর, দেশের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ, বাদশা যদি এতে ‘মাসলাহাত’ (কল্যাণ) আছে বলে মনে করেন, তাহলে আমরা তাদের সাথে আছি। বাদশাই শেষ কথা। তিনি যা ভালো মনে করেন, তাই হবে। তিনি ভালো বললে আমরা শুধু শুধু কোন দুঃখে তাদেরকে খারাপ বলে দেশে বিশৃঙ্খলা মাচাতে যাব?

৫: আধুনিক ইসলামিস্ট: সমকাম খারাপ। নাহি আনিল মুনকার (মন্দ কাজে বাধা দান)-এর দায়িত্ব হিশেবে আমরা এই কাজের নিন্দা জানাচ্ছি। লূত আ.-এর কর্মকৌশলই এমন ছিল,

إِذۡ قَالَ لَهُمۡ أَخُوهُمۡ لُوطٌ أَلَا تَتَّقُونَ إِنِّی لَكُمۡ رَسُولٌ أَمِین فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِیعُونِ

যখন তাদের ভাই লুত তাদেরকে বলল, তোমরা কি আল্লাহকে ভয় কর না? নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য এক বিশ^স্ত রাসূল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর (শু‘আরা ১৬১-১৬৩)।

৬: রব্বানী (প্রকৃত আল্লাহওয়ালা): এরা সমাজের বিষাক্ত অংশ। এরা বিকৃতরুচির লোক। আল্লাহর সৃষ্টিপ্রকৃতির উল্টো আচরণ করছে এরা। এরা যেহেতু ‘হকপথ’ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, সুতরাং এদের ব্যাপারে কর্মকৌশল সেই আগেরটাই,

فَلَمَّا جَاۤءَ أَمۡرُنَا جَعَلۡنَا عَـٰلِیَهَا سَافِلَهَا وَأَمۡطَرۡنَا عَلَیۡهَا حِجَارَةࣰ مِّن سِجِّیل مَّنضُود مُّسَوَّمَةً عِندَ رَبِّكَۖ وَمَا هِیَ مِنَ ٱلظَّـٰلِمِینَ بِبَعِید

অতঃপর যখন আমার হুকুম এসে গেল, তখন আমি সে জনপদের উপর দিককে নিচের দিকে উল্টে দিলাম এবং তাদের উপর থাকে থাকে পাকা মাটির পাথর বর্ষণ করলাম। যা আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হতে হিনহিত ছিল (হুদ ৮২-৮৩)।

৭: এই খবীসদের উপর আযাব নেমে এসেছিল উপর থেকে। বর্তমানেও। সিসি ক্যামেরায়ও ধরা পড়েনি।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□চিন্তার নোঙ্গর!□□

-

১: নোঙ্গরের কাজ কী? জাহাজকে আটকে রাখা। বন্দরে ভেড়ার পর নোঙ্গর ফেলে নাবিক নিশ্চিন্ত মনে নেমে যায়। আর ভয় নেই। ঝড়-তুফান এলেও জাহাজ বন্দর ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না। অবশ্য ঝড়ের প্রকোপ তীব্র হলে, কখনো কখনো নোঙ্গরের কাছি ছিঁড়ে জাহাজ মাঝদরিয়ার চলে যায় বা ডুবে যায়।

২: আমাদের চিন্তারও নোঙ্গর আছে। কুরআন ও সুন্নাহ হল মুমিনের চিন্তার নোঙ্গর। এক অদৃশ্য কাছির মাধ্যমে মুমিনের ঈমান-আকীদার নোঙ্গর কুরআন কারীমের সাথে বাঁধা থাকা আবশ্যক। দ্বীনের গ-ীর বাইরে পা বাড়াতে গেলেই যেন নোঙ্গরে টান খেয়ে আবার শরীয়তের চৌহদ্দীতে ফিরে আসতে পারি।

৩: ঝড়ের প্রবল ঝাপটা মাঝেমধ্যে যেমন নোঙ্গরের কাছি ছিঁড়ে ফেলে, আমিও যদি শরীয়তের বাইরে যাওয়ার জন্য সবসময় ছটফট করতে থাকি, তাহলে দেখা যাবে, একসময় আমার মনের নোঙ্গরের কাছি ছিঁড়ে গেছে। আমি চেষ্টা করব, সবসময় নোঙ্গরের কাছিকে নিরাপদ রাখতে। যাতে লাগামহীন হয়ে পাপের মাঝদরিয়ায় গিয়ে হাবুডুবু না খাই। চেষ্টা করব কুরআনে সাথে সবসময় লেগে থাকতে।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□জাবর কাটা!□□

-

১: তালিবে ইলমদের বলি, শয়নে-স্বপনে-জাগরণে শুধু কুরআন নিয়ে ভাববে। কুরআন নিয়ে থাকবে। কুরআন নিয়ে ঘুমুবে। এমনকি ভাতের সাথেও কুরআন কারীম খাবে। যখন-যাই করো, সেই কাজ, সেই মুহূর্ত, সেই ভাবনা, সেই পাঠের সাথে সামঞ্জস্য রাখে এমন আয়াত খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।

২: শুধু কুরআন তিলাওয়াতের সময়ই নয়, কুরআন শরীফ থেকে দূরে অবস্থানের সময়ও কুরআনকে সাথে মাথায় রাখবে। অন্য পড়াশোনার ক্ষেত্রেও আমরা তালিবে ইলমদেরকে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে বলি। একটা সূরা পড়া হয়েছে, একটা অধ্যায় পড়া হয়েছে, সাথে সাথে কুরআন/কিতাব বন্ধ করে, মনে মনে জপবে, এতক্ষণ কী পড়লাম। কী শিখলাম। কী অর্জন করলাম।

৩: গরু দেখেছ? কিছুক্ষণ বেঁধে রাখলে, গরু কী করে আগে খাওয়া ঘাসগুলো আবার বের করে এনে চিবুতে থাকে। এটাকে বলে জাবর কাটা। শিক্ষাক্ষেত্রেও জাবর কাটা পদ্ধতি বেশ কার্যকর। গরু একবারের খাবারকে কয়েকবারের খাবারে পরিণত করতে পারে। পাশাপাশি রশিতে বাঁধা থাকার বিরক্তিকর মুহূর্তকে জাবর কাটার মাধ্যমে উপভোগ্য আর সুখকর করে তোলে।

৪: তুমি আমিও পারি, কুরআনী আয়াতকে চিন্তার জাবর কাটার মাধ্যমে একান্ত আপন করে তুলতে। বসে আছি, ভাবতে শুরু করি আমার প্রিয় আয়াত কি কি? কোন কোন আয়াত আমাকে জীবনে বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছে। আমি আদৌ কোনও আয়াত মনে করতে পারছি কি না? না পারলে, কিছু আয়াতকে আপন করে নেয়ার প্রক্রিয়া কেন এখন থেকেই শুরু করে দিচ্ছি না?

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ জ্ঞানী শিশু! □□

-

১: এক মা তার ঘরের বিভিন্ন দরজার উপরে নেমপ্লেটের মতো করে যিকির লিখে টাঙ্গিয়ে দিয়েছেন। কোনও কামরার দরজায় লেখা ‘সুবহানাল্লাহ কক্ষ’। কোনও কামরার দরজায় লেখা ‘আলহামদুলিল্লাহ কক্ষ’। আরেক কামরার দরজায় লেখা ‘আল্লাহু আকবার কক্ষ’। রান্নাঘরের দরজায় লেখা ‘ইস্তেগফার কক্ষ’। বৈঠকখানার দরজায় লেখা ‘তাহলীল কক্ষ’।

২: মেহমান এলে অবাক হয়। এটা কেন? মায়ের সহাস্য উত্তর,

-আমি আমার সন্তানদেরকে ‘জ্ঞানী’ বানাতে চাই।

-জ্ঞানী বানানোর সাথে, দরজার উপরে এসব লেখার কী সম্পর্ক?

- কুরআন কারীমে প্রকৃত জ্ঞানীকে উলুল আলবাব (أُو۟لُوا۟ ٱلۡأَلۡبَـٰبِ) বা জ্ঞানের অধিকারী বলা হয়েছে। এই জ্ঞানীরা কারা? আল্লাহ তা‘আলাই বলে দিচ্ছেন,

- যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে, সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে (আলে ইমরান ১৯১)।

আমি চাই আমার সন্তানরাও সর্বাবস্থায় যিকিরে অভ্যস্ত হোক। তারা আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা হোক।

৩: এই মা যখন যে কামরায় প্রবেশ করতেন, সন্তানদের শুনিয়ে শুনিয়ে সেই যিকির করতে থাকতেন। সন্তান আর সন্তানদের পিতাও তার দেখাদেখি এই আমলে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাহলীলের কামরায় প্রবেশ করেই শিশুরা সমস্বরে বলে উঠছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। ইস্তেগফারের কামরায় প্রবেশ করেই আস্তাগফিরুল্লাহ বলে উঠছে। আস্তে আস্তে এমন হয়েছে, বাড়িতে মেহমান এলে, মেহমান শিশুরাও এ-কামরা ও-কামরায় হুটোপুটি করতে করতে যিকির যিকির খেলা শুরু করে।

৪: সন্তানদেরকে আল্লাহর যিকিরে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য এই মায়ের প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে। মা-ই হলেন সন্তানের প্রথম মাদরাসা।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ খুকি ও দুধবেড়ালী! □□

-

১: মাদরাসার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ছোট্ট এক খুকি বোতলে করে দুধ নিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি কাড়ল খুকির খরগোশ লাফ। যেভাবে ছোট্ট পনিটেইল ঝুঁটি উড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে, ঝাঁকিতে বোতলের ছিপি উপছে দুধ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। খুকির এতকিছু খেয়াল করার সময় কোথায়! আপন খেলায় মগ্ন। খুকির দৌড় বন্ধ হয়ে গেল। সামনে একটা অলস বেড়াল বসে বসে লেজ চাটছিল। বেড়ালের চোখ পড়ল খুকির উপর। বেড়াল সাধারণত এমন করে না। কিন্তু এই দুষ্ট বেড়ালটা খুকির দিকে পায়ে পায়ে এগুতে লাগল। খুকি ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পেছাতে শুরু করল।

২: খানিক দূর এসে, লোকজন দেখে বেড়াল থমকে গেল। খুকিও নিরাপদ দূরত্বে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ভয়ে ভয়ে একবার বেড়ালের দিকে তাকায়, আরেকবার পেছন দিকে তাকায়। ভেবে কূলকিনারা করে উঠতে পারছে না, বেড়ালকে ডিঙ্গিয়ে এই অথৈ দূরত্ব কী করে পাড়ি দেবে?

৩: খুকির অসহায় অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। বড় ভাই দৌড়ে এল। বীরপুরুষ ভাইটা হুলোটাকে তাড়িয়ে গলিছাড়া করল। বোনকে বাঘের মাসির কবল থেকে উদ্ধার করে, ঘরে নিয়ে গেল। বেড়ালটি দূর হতেই খুকি আবার আগের মতো নাচতে নাচতে বাসামুখো হল।

৪: গাড়িতে উঠে অভ্যেসবশ ভাবতে বসলাম, কুরআন কারীমে এমন কোনও চিত্র কি আছে? কয়েকটা ঘটনা মাথায় ক্লিক করল। ইউসুফ আ. ও তার ভাইদের ঘটনা। সূরা কালামে বাগানঅলা ভাইদের কথাবার্তা। হাবীল কাবীলের ঘটনা। ইসহাক ও ইসমাইলের ঘটনা। মারয়াম ও ইয়াহইয়ার ঘটনা। আর আপন ভাইবোনের ঘটনা সরাসরি একবারই আছে। মুসা ও তার বোনের ঘটনা।

৫: সন্তানের চিন্তায় ব্যাকুল মা পাঠালেন মেয়েকে। বলে দিলেন (قُصِّیهِۖ) মুসাকে অনুসরণ করে পিছু পিছু যাও। দুধের শিশুর সুরক্ষায় বোনকে পাঠিয়েছেন। দুধখুকির জন্যও মা তার পিছু পিছু ভাইকে পাঠিয়েছেন। যুগে যুগেই মায়েরা এমন বাৎসল্য দেখিয়ে এসেছেন। ছোট সন্তানকে একা একা কোথাও পাঠাতে নেই। সাথে কাউকে দিতে হয়। মুসার মা দিয়েছেন। আমাদের খুকির মাও দিয়েছেন। আচ্ছা, বস্তিতে বাস করা এই মা কি জানেন, তিনি একটি কুরআনি আমল করেছেন?

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ সুখী দাম্পত্য! □□

-

১: একজন প্রশ্ন করল,

-আমাকে স্রেফ দুই শব্দে সুখী দাম্পত্য জীবন লাভের উপায় বাতলে দিন তো! লম্বাচওড়া বয়ান মনে থাকে না।

-দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে চাইলে দুই শব্দই যথেষ্ট। আল্লাহ তা‘আলাই দুই শব্দে সুখী দাম্পত্যের রূপরেখা এঁকে দিয়েছেন।

১: মাওয়াদ্দাহ (مَوَدَّة)। প্রগাঢ় ভালবাসা।

২: রহমাহ (رَحْمَة)। অনুকম্পা। দয়া।

পরস্পরের আচার-আচরণে এ-দু’টি বিষয় বিদ্যমান থাকলে কী হবে?

-সেটাও আল্লাহ তা‘আলা এক শব্দে প্রকাশ করেছেন।

সাকান (سَكَن) আরাম, প্রশান্তি আসবে।

২: আমি রাগ-বিরাগ-অনুরাগ সবসময় মনে রাখব, স্বামী হলে স্ত্রী বা স্ত্রীদের প্রতি মাওয়াদ্দাহ ও রহমাহপূর্ণ আচরণ করছি তো?

৩: স্ত্রী হলে মনে রাখব, আমার আচরণেও রহমাহ বা মাওয়াদ্দাহ থাকছে তো?

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ সন্তানের সলাত! □□

-

১: পিতা হিশেবে ইবরাহীম আ. অসাধারণ ছিলেন। নবীগন সবদিক দিয়েই অসাধারণ হয়ে থাকেন। তিনি দু‘আ করলেন (رَبِّ ٱجۡعَلۡنِی مُقِیمَ ٱلصَّلَوٰةِ) ইয়া রাব্ব, আমাকে সলাত কায়েমকারী বানিয়ে দিন। তারপর আগে বেড়ে বললেন (وَمِن ذُرِّیَّتِیۚ) আমার বংশধরদের থেকেও সলাত কায়েমকারী বানিয়ে দিন।

২: সন্তানের সলাতের প্রতি চৌকান্না থাকা, পিতার উপর কুরআনি দায়িত্ব। একজন পিতা তার শিশু সন্তানদের মন-মগজে সলাতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বসিয়ে দেয়ার জন্য, চমৎকার এক পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন।

৩: সন্তানরা বাবার কাছে কতকিছুর বায়না ধরে! পছন্দমত খেলনা পোশাকের আবদার জুড়ে দেয়। উক্ত পিতা বাসায় নিয়ম করে দিয়েছিলেন, তার কাছে সন্তানদের কিছু চাওয়ার থাকলে, তারা যেন যে কোনও সলাতের পর চায়।

৪: এ-বিষয়ে বাবার বক্তব্য হল,

-আমি সন্তানদের বলে দিয়েছি, নামাযের পর রাব্বে কারীমের ইবাদত ও কুরআন কারীমের ছোঁয়ায়, আমার মনে সুখি সুখি ফুরফুরে আমেজ থাকে। দিলটাও থাকে বেজায় খোশ। তোমরা বৈধ ও যৌক্তিক কিছু চাইলে, আমি পূরণ করার চেষ্টা করব।

৫: বাবা বললেন,

-মাঝেমধ্যে এমনও হয়, অন্য সময় চাওয়ার কারণে, যৌক্তিক কোনও চাহিদা পূরণ করিনি। নামাজের পর তাকে কাছে ডেকে বলি, তুমি তখন ‘ওটা’ চেয়েছিলে। এখনও কি সেটা পাওয়ার ইচ্ছা আছে? তুমি চাইলে কিনে দেব। এখন নামাজ পড়েছি তো, নামাজের প্রভাবে মনটাও খুশি আছে।

৬: বাবার উপর সলাতের সরাসরি প্রভাব দেখতে পায়। তাদের মনে গাঁথা হয়ে যায়, সলাত শুধু আল্লাহর হুকুম পালনই নয়, সলাতের কারনে দৈনন্দিন জীবনেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। সলাতের ছোঁয়ায় আব্বু অনেক বেশি ‘আব্বু’ হয়ে ওঠেন। আম্মু আরও বেশি ‘আম্মু’ হয়ে ওঠেন।

৭: এমন বাবা-মায়ের সন্তান কখনো সলাতবিমুখ হতে পারে না। এমন বাবা-মায়ের সন্তান বড় হয়েও ‘হিজাব-নিকাবের’ বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না।

৮: এমন বাবা-মা হতে, বড় আলিম বা শায়খ হওয়াও জরুরী নয়। অতি সাধারণ একজন বাবা-মা’ও এমন হতে পারেন। সন্তানকে করে তুলতে পারেন আজীবনের সলাতপ্রেমী।

৯: আর হাঁ, সন্তানকে সলাত কায়েমকারী বানাতে, সূরা ইবরাহীমের ৪০ নাম্বার আয়াতের দু‘আটা নিয়মিত পড়ার কোনও বিকল্প নেই। সাথে ৪১ আয়াতের দু‘আটাও পড়ে নিতে পারি।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ উৎকৃষ্ট প্রতিপালন!□□

-

১: মুয়াজ্জিন সাহেবের শিক্ষাগত যোগ্যতা খুবই অল্প। মাদরাসায় কয়েক জামাত পড়েছেন। জীবন ও জীবিকার তাগিদে আল্লাহর ঘরের খেদমতে লেগে গেছেন। সুন্দর করে আযান দিতে পারেন। শুদ্ধ করে তিলাওয়াত করতে পারেন। ফাঁকে-ফুঁকে ভোরে সুমধুর সুরে মসজিদের মাইকে গযল গাইতে পারেন। মসজিদকে সবসময় ঝকঝকে তকতকে রাখতে পারেন।

২: ব্র্যাকস্কুল, কিন্ডারগার্টেনের তোড়ে সবাহী (প্রভাতী) নুরানী মক্তবগুলোর নাভিশ্বাস অবস্থা। মসজিদভিত্তিক নুরানী মক্তবগুলো প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে বললেই চলে। এই মুয়াজ্জিন সাহেব সকালে না পারলেও, নিজ উদ্যোগে বিকেলে মক্তব চালু করেছেন। তার শিক্ষাদান পদ্ধতিও বেশ চমৎকার। তার ছাত্ররা নিয়মিত মসজিদে এসে নামায আদায় করার চেষ্টা করে।

৩: একটি শিশু মক্তবে নিয়মিত আসে। মসজিদেও আসে। তবে খুবই দুষ্টুমি করে। জামাতের সময় ছোটাছুটি করে। বড়দের ভয়ে নিয়ত বেঁধে দাঁড়ালেও সারাক্ষণ ইতিউতি তাকায়। দু’দণ্ড সুস্থির হয়ে দাঁড়ায় না। মুয়াজ্জিন সাহেব শিশুটিকে কাছে ডাকলেন। প্রথমে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। কোমল গলায় বললেন,

-জানো খোকা, তোমাকে আমার খুউব ভালো লাগে?

-কেন?

-কারণ আল্লাহ তা‘আলারও যে তোমাকে খুউব ভালো লাগে!

-আচ্ছা তাই? আমাকে কেন আল্লাহর এত ভাল লাগে?

-তুমি দেখছ না, তোমার বন্ধুরা সবাই মাঠে খেলছে, আযান শুনে মসজিদে আসেনি। খেলা বন্ধ করেনি। তুমি তাদের সাথে থেকেও আযান শুনে চলে এসেছ। আমি জোহরের পরে মক্তবে তোমাদেরকে কত করে বলে দিয়েছি, আসরের আযান হলেই মসজিদে চলে আসবে। কই, তারা আসেনি। এখন বল, তুমি আল্লাহর জন্য প্রিয় খেলা ছেড়ে চলে এসেছ, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন না তো কাকে ভালোবাসবেন?

শিশুটির চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মুয়াজ্জিন সাহেব এবার বললেন,

-তুমি কি চাও, আল্লাহ তোমাকে আরও বেশি ভালোবাসেন?

-জি¦ ওস্তাদজি চাই।

-কাল তোমাকে মসজিদগলির কাঠের দোকানে নিয়ে গিয়েছিলাম। মনে আছে?

-জি¦, আছে ওস্তাদজি!

-আমরা যখন গিয়েছি ছুতার (কাঠমিস্ত্রি) তখন হাতুড়ি দিয়ে একটা চেয়ারের পায়ায় পেরেক ঠুকছিল। তুমি খেয়াল করেছ, মিস্ত্রি কী মনোযোগ দিয়েই না হাতুড়ি দিয়ে পেরেকে আঘাত করছিল। মিস্ত্রি গভীর শান্তদৃষ্টিতে একধ্যানে পেরেকের দিকে তাকিয়ে ছিল। অন্য কোনও দিকে মনোযোগ ছিল না। তুমি বলো তো খোকা, মিস্ত্রি যদি হাতুড়ি মারার সময়, অস্থির হয়ে অনদিকে চোখ ফেরাত তাহলে কী হত?

-মিস্ত্রির আরেক হাতের উপর হাতুড়ির আঘাত লাগত।

-ঠিক ধরেছ। তুমি যে নামাজে এদিক সেদিক তাকাও, অস্থির দৌড়াদৌড়ি করো, এতে কিন্তু তোমার নামায আহত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ছুতার যেমন একদৃষ্টিতে শান্ত হয়ে পেরেকের দিকে তাকিয়ে থাকে, তুমিও যখন নামাযে দাঁড়াবে, একদৃষ্টিতে সিজদার স্থানের দিকে তাকিয়ে থাকবে। এদিক সেদিক তাকাবে না। অস্থিরতা প্রকাশ করবে না। তাহলে আল্লাহর রহমত তোমার উপর এসে পড়বে।

.

মুয়াজ্জিন সাহেবের ঘটনা থেকে মনটা কুরআনে ডুব দিল,

১: আল্লাহ তা‘আলা মারয়ামকে উৎকৃষ্ট পন্থায় প্রতিপালন করলেন (وَأَنۢبَتَهَا نَبَاتًا حَسَنࣰا)। আলে ইমরান ৩৭।

২: শিশুকে লালনপালন করতে হবে উৎকৃষ্টতম পন্থায়। শিশুকে সলাত শিক্ষা দিতে হবে উৎকৃষ্টতম পন্থায়। হযরত লুকমানও সন্তানকে সলাতের আদেশ করেছেন।

৩: সন্তানকে দীক্ষাদানের ব্যাপারে, কুরআন কারীম সবসময় আলোচনার পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। পাশাপাশি পিতা-মাতা দু‘আ করে গেছেন। ইবরাহীম আ. ইসমাইলের সাথে কুরবানির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনাসাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

৪: ইবরাহীম আ. সলাতের ব্যাপারে সন্তান ও বংশধরদের জন্য দু‘আ করেছেন। লুকমানও সন্তানের সাথে আলোচনার ভঙ্গি গ্রহন করেছেন। মুয়াজ্জিন সাহেবও তার শিষ্যকে সংশোধনের জন্য দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার ভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। ফেলো তক্তা মারো পেরেক ভঙ্গি গ্রহণ করেননি।

৫: সন্তানের ভুল সংশোধনে কুরআন বলে, আলোচনা করতে। প্রথমেই মুগুর হাতে তেড়ে যেতে বলেনি। নূহ আ.ও জীবন-মৃত্যুর চরম সঙ্গীন মুহূর্তেও আলোচনার মাধ্যমে সন্তানকে নৌযানে উঠে আসতে বলেছিলেন।

৬: মুযাজ্জিন সাহেব নবীঅলা পদ্ধতিতেই শিষ্যকে সংশোধনে ব্রতী হয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীমে ইসমাইল আ.-এর আলোচনা খুব বেশি করেননি। ইসমাইল আ.-এর গুরুত্বপূর্ণ দু’টি গুণ তুলে ধরেছেন (وَكَانَ یَأۡمُرُ أَهۡلَهُۥ بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱلزَّكَوٰةِ)। তিনি নিজ পরিবারবর্গকে সলাত ও যাকাত আদায়ের হুকুম করত (মারয়াম ৫৫)।

৭: আল্লাহ তা‘আলা ইসমাইলের ব্যাপারে বলেছেন (وَكَانَ عِندَ رَبِّهِۦ مَرۡضِیࣰّا) সে ছিল নিজ প্রতিপালকের কাছে সন্তোষভাজন।

৮: মুয়াজ্জিন সাহেব কি জানেন, তার চমৎকার ভঙ্গিটি নবীগনের কাজের সাথে মিলে গেছে? তিনিও আল্লাহর সন্তোষভাজনদের তালিকায় উঠে আসার প্রক্রিয়ায় আছেন?

৯: মুয়াজ্জিন সাহেব কি জানেন, তিনি শিশুটিকে মসজিদ থেকে তাড়িয়ে না দিয়ে, তার সাথে আলোচনার ভঙ্গি গ্রহণ করে, অপূর্ব কুরআনি চাদরে নিজেকে জড়িয়েছেন?

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ কুরআনি মোহর! □□

(০৬-০৭-১৯)

-

১: সালাফের জীবনী পড়লে দেখি, তাঁদের জীবন ছিল কুরআনময়। সুন্নাহময়। তাঁরা জীবনের পরতে পরতে কুরআন কারীমের বারাকাহ অনুভব করতেন। বর্তমানেও কি আমরা এমন বারাকাহর ছোঁয়া পেতে পারি? কুরআনী বরকতের ছোঁয়া আমাদের মতো গুনাহগার বান্দার পক্ষেও কি পাওয়া সম্ভব? এক জর্দানি ভাই (আবু আবদুল মালিক) তার জীবনের গল্প শুনিয়েছেন।

২: আমার স্ত্রীর নাম ‘বায়ান’। শায়খ আলি তানতাবী রহ.-এর মেয়ের নামও ছিল ‘বায়ান’। তাঁকে জার্মানিতে খ্রিস্টান সন্ত্রাসীরা উপুর্যপরি ছুরিকাঘাত শহীদ করে দিয়েছিল।

৩: আমি আমার জীবনের পদে পদে কুরআনের বরকত পেয়েছি। এটা সম্ভব হয়েছে আমার প্রাণাধিকা স্ত্রীর উসীলায়। আমার স্ত্রীর পবিত্র সঙ্গ না পেলে, আমার মতো গুনাহগার বান্দার পক্ষে কুরআনের ছায়াতলে যাওয়া সম্ভব হত কি না আল্লাহমালুম।

৪: দুই পরিবারের সম্মতিক্রমে আমরা দু’জন মুখোমুখি হলাম। আমার বেশি কিছু জানার ছিল না। যা জানার আগেই জেনে নিয়েছি। নিয়মিত নামায পড়ি। মুখে দাঁড়ি আছে। ওটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল আমার ধার্মিকতা। যতদুর জেনেছি ‘বায়ান’-এর ধার্মিকতার মাত্রা আরও অনেকদূর এগিয়ে ছিল। তাই ভয়ে ভয়ে ছিলাম, আমার ধার্মিকতার মাত্রা আঁচ করে, এই বিয়েতে গররাজি হয় কি না। দেখেছি প্রকৃত ধার্মিক মেয়েরা কিছুতেই অধার্মিক পাত্র পছন্দ করে না। অন্য দেশের কথা জানি না, আমাদের জর্ডানে ধার্মিক পরিবারের মেয়েরা এমনই। তারা গরীব হলেও ধার্মিক পাত্রকে জীবনসঙ্গী হিশেবে বেছে নিতে দ্বিধা করে না।

৫: আমার প্রশ্ন শেষ হলে, বায়ান শালীনতা বজায় রেখে জানতে চাইলেন,

-মোহরানা সম্পর্কে আপনার কোনও চিন্তা আছে?

আমি থমকে গেলাম। মোহরানা সম্পর্কে আলাদা কোনও চিন্তাই ছিল না। দুইপক্ষর মুরুব্বীগন যা নির্ধারণ করবেন, সেটাই মেনে নেব। এর বাইরে মোহর নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনা আর কী হতে পারে, অনেব ভেবেও কূলকিনারা করতে পারলাম না। আবার হুট করে কিছু বললে, পাছে আমার ধর্মবিষয়ে অজ্ঞতা ফাঁস হয়ে যায়, সে-নিয়েও সতর্ক ছিলাম। আমাকে চুপ করে ভাবতে দেখে, বায়ান বললেন,

-বিয়েতে মোহর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্ব। মোহরানা আমাদের দু’জনের বিষয়। আমার একান্ত ইচ্ছা, এখানে সম্পর্ক ঠিক হলে, মোহরানা নির্ধারণের পুরো ব্যাপারটা আমরাই দেখব।

৬: আমি বয়ানের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে চিন্তায় পড়ে গেলাম। বয়ান কি প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী মোটা অংকের মোহরের আশা করছে? এবং নগদ আদায়ের কথা চিন্তা করছে? চিন্তায় ছেদ পড়ল বয়ানের পরের কথায়,

-আপনার কাছ থেকে আমার বেশি কিছু জানার নেই। শুধু দু’টি বিষয় জানার আছে,

ক: আমি চাই আমার জীবনসঙ্গী আমাকে সবসময় আল্লাহমুখী হতে সাহায্য করবেন। আর কুরআন কারীম ও সুন্নাহর অনুসরণ ছাড়া এটা সম্ভব নয়। আপনার পক্ষে কি এটা সম্ভব হবে?

বয়ানের কথা শুনে আমার এত আনন্দ হল! এত আনন্দ হল,ইচ্ছে হচ্ছিল চীৎকার করে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠি। খুশিতে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি এসে যাওয়ার জোগাড় হল। বুঝে গেলাম, আমি একটি অমূল্য রতন পেতে যাচ্ছি। নিজেকে সামলে উত্তর দিলাম,

-রাব্বে কারীম এখানে সম্বন্ধ চূড়ান্ত করলে, আমি আমার জীবনের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব, আপনাকে সবসময় আল্লাহমুখী রাখতে। যত বাধাই আসুক, আমি আপনাকে তাকওয়ার পরিবেশে রাখতে কসুর করব না। ইন শা আল্লাহ।

৭: বয়ান বোধহয় আমার চাপা উচ্ছ্বাস টের পেয়ে গিয়েছিল। মুচকি হেসে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল,

-আপনি কুরআন কারীমের কতটুকু হেফয করেছেন?

প্রশ্নটা শুনে রীতিমতো আঁতকে উঠলাম। সত্যি সত্যি ধরা পড়ে যাওয়ার আশংকা করলাম। আমি মোটামুটি ধার্মিক। কিন্তু কুরআন কারীম হেফয করার মতো ধার্মিক নই। যা হওয়ার হবে, সত্যটা বলে দেই,

-ছোটবেলায় দশ পারা হেফয করেছি। এখন মনে নেই।

আমার উত্তর শুনে বয়ান চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবল। ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। এই বুঝি ‘অমূল রতন’ হারাচ্ছি! বয়ান বুঝি না-বোধক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে! যত দোয়া-দুরুদ মনে ছিল, সব একসাথে আওড়ে আল্লাহর কাছে পেশ করে যাচ্ছিলাম। বয়ান চোখ খুললেন। অত্যন্ত ধীরে ধীরে বললেন,

-তাহলে আমি চাই আমার মোহরানা হোক কুরআন কারীম। মোহরানা দুই ধাপে আদায় করতে হবে,

প্রথম ধাপ: নগদ আদায় (المهر المعجل) পছন্দমতো একটি কুরআন কারীম।

দ্বিতীয় ধাপ: বকেয়া আদায় (المهر المؤجل)। পুরো কুরআন কারীম হিফয।

৮: হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বয়ানকে দৃঢ় আশ^াস দিয়ে বললাম,

-আপনি এই বিয়েতে সম্মতি দিলে, আমি বিয়ের পর, সবকাজ ছেড়ে কুরআন কারীম হিফযে মশগুল হয়ে যাবো। রুজি-রোজগারের চিন্তা নেই। ওটা আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন। আপনার উসীলায় আল্লাহ তা‘আলা আমাকে হিফযের তাওফীক দিলে, নিজেকে ধন্য মনে করব। আপনি কিছু মনে না করলে বলতে দ্বিধা নেই, আপনাকে পেলে আমার জীবন কানায় কানায় ভরে উঠবে। আপনাকে পাশে পেলে, আমিও সহজে আল্লাহর পথে চলতে পারব। ইন শা আল্লাহ।

৯: বয়ান দয়া করে আমাকে তার জীবনসঙ্গী হিশেবে বেছে নিয়েছে। তার মতো ‘জান্নাতী’ হুরতুল্য মানুষ আমাকে পছন্দ করেছে, এজন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না। সেদিন তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর থেকেই উঠেপড়ে লেগে গেলাম। আবার আমাদের দেখা হওয়ার আগেই আগেই যেন হিফয কিছুদূর এগিয়ে রাখতে পারি। যাফাফ (বাসর) রাতেই তাকে সুসংবাদ শোনাতে পারি। বাড়ির সবাই বিয়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। আমিও বিয়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। শুধু ধরণ আলাদা। আমি মশগুল কুরআন হিফয নিয়ে, তারা মশগুল কেনাকাটা নিয়ে। বাড়ির বড়ছেলের বিয়ে বলে কথা!

১০: বিয়ের আগে থেকেই নানাভাবে কুরআন কারীমের বরকতের ছোঁয়া পেতে শুরু করলাম। বুঝতে অসুবিধা হল না, ‘বয়ান’-ই হল আমার জন্য মূল বারাকাহ। বিয়ের পর বয়ানের কাছেই হিফয শোনাতে শুরু করলাম। হিফযের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিলাম। আমেরিকান বস অবাক হলেও ছুটি মঞ্জুর করলেন। ছুটি না পেলে চাকুরি ছেড়ে দিতাম।

১১: বয়ানের সাথে কিছুদিন থাকার পর, বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, আস্তে আস্তে আমার ভেতরের ধার্মিকতা অন্যমাত্রায় রূপ নিচ্ছে। বয়ান বা কুরআন বা উভয়ের প্রভাবে আমার ভেতরে দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি এক ধরনের নির্মোহ ভাব তৈরী হতে লাগল। তখন ইরাকে আমেরিকাবিরোধী জিহাদ শুরু হয়েছে। বয়ান নিয়মিত সেসব খবর রাখত। আমার সাথেও এসব নিয়ে আলাপ করত।

১২: হিফয শেষ হতে হতে আমি এক অন্য মানুষে পরিণত হলাম। ততদিনে বয়ান আর আমি ঠিক করে ফেলেছি, প্রথম সুযোগেই ইরাকে চলে যাব। মাযলুম ভাইদের সাহায্য করব। চাকুরিতে আর যোগ দেব না। আমাদের জর্দান থেকে অনেকেই ইরাকে যাচ্ছেন।

১৩: আমার সবক তখন সূরা ইউনুসে। বয়ানকে সেদিনের পড়া শোনাচ্ছি,

هُوَ الَّذِي يُسَيِّرُكُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ۖ حَتَّىٰ إِذَا كُنتُمْ فِي الْفُلْكِ وَجَرَيْنَ بِهِم بِرِيحٍ طَيِّبَةٍ وَفَرِحُوا بِهَا جَاءَتْهَا رِيحٌ عَاصِفٌ وَجَاءَهُمُ الْمَوْجُ مِن كُلِّ مَكَانٍ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ أُحِيطَ بِهِمْ ۙ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ لَئِنْ أَنجَيْتَنَا مِنْ هَٰذِهِ لَنَكُونَنَّ مِنَ الشَّاكِرِينَ

فَلَمَّا أَنجَاهُمْ إِذَا هُمْ يَبْغُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ ۗ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّمَا بَغْيُكُمْ عَلَىٰ أَنفُسِكُم ۖ مَّتَاعَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ ثُمَّ إِلَيْنَا مَرْجِعُكُمْ فَنُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ

তিনি তো আল্লাহই, যিনি তোমাদেরকে স্থলেও ভ্রমণ করান এবং সাগরেও। এভাবে তোমরা যখন নৌকায় সওয়ার হও আর নৌকাগুলো মানুষকে নিয়ে অনুকূল বাতাসে পানির উপর বয়ে চলে এবং তারা তাতে আনন্দ-মগ্ন হয়ে পড়ে, তখন হঠাৎ তাদের উপর দিয়ে তীব্র বায়ু প্রবাহিত হয় এবং সব দিক থেকে তাদের দিকে তরঙ্গ ছুটে আসে এবং তারা মনে করে সব দিক থেকে তারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছে, তখন তারা খাঁটি মনে কেবল আল্লাহর প্রতি বিশ^াসী হয়ে শুধু তাঁকেই ডাকে (এবং বলে, হে আল্লাহ!) আপনি যদি এর (অর্থাৎ এই বিপদ) থেকে আমাদেরকে মুক্তি দেন, তবে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব।

কিন্তু আল্লাহ যখন তাদেরকে মুক্তি দান করেন, তখন অবিলম্বেই তারা যমীনে অন্যায়ভাবে অবাধ্যতা প্রদর্শন করে। হে মানুষ! প্রকৃতপক্ষে তোমাদের এ অবাধ্যতা খোদ তোমাদেরই বিরুদ্ধে যাচ্ছে। সুতরাং তোমরা পার্থিব জীবনের মজা লুটে নাও। শেষ পর্যন্ত আমারই নিকট তোমাদের ফিরতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে তোমরা যা-কিছু করছ তা অবহিত করব (ইউনুস ২২-২৩)।

১৪: কেন জানি না, আমি যখন প্রথম আয়াতখানা পড়ছিলাম, বয়ান হু হু করে কেঁদে দিল। দ্বিতীয় আয়াত পড়ার সময় তার কান্না আরও বেড়ে গেল। তার দেখাদেখি আমার চোখেও পানি চলে এল। সে হয়তো কুরআন শুনে কেঁদেছে। পড়া থামিয়ে দিলাম। বয়ান যেভাবে কুরআন কারীম বুঝত, উপলব্ধি করত, আমি সেভাবে পারতাম না। তবুও সাথে থাকার কারণে, আমার মধ্যেও কুরআন কারীম ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল।

১৫: এই দুই আয়াতই ছিল বয়ানকে শোনানো আমার শেষ হিফয। তারপর বয়ান ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। আর সুস্থ হল না। আমাকে ছেড়ে আল্লাহর কাছে চলে গেল। তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় কুরআন দিয়ে। শেষ পরিচয় সূরা ইউনুস দিয়ে।

১৬: আমি ভুল করলে, সুন্দর করে বুঝিয়ে সংশোধন করে দিত। আমার আমলে গাফলতি দেখলে, আমার ব্যক্তিত্বে বিন্দুমাত্র আঘাত না করে, গভীর বুদ্ধিমত্তার সাথে সচেতন করে দিত। বয়ান চলে গেছে। আমার জন্য রেখে গেছে কুরআন। অবস্থা এমন হল, বয়ানের কথা মনে এলে, সাথে সাথে কুরআনের কথা মনে পড়ে যায়। সলাতে, বাইরে যখনই কুরআন তিলাওয়াত করি, সাথে সাথে বয়ানের হাজারো স্মৃতি এসে হৃদয়পটে ভীড় করে। অজান্তেই বয়ানের জন্য বুক ভেঙে কান্না আসে। মুনাজাতে হাত তুললেই বয়ানের জন্য দিল থেকে দু‘আ আসে।

১৭: বয়ান নেই। আছে তার রেখে যাওয়া কুরআন। এই কুরআনখানা মোহরানাস্বরূপ তাকে দিয়েছিলাম। ইরাকে মার্কিন বাহিনীর প্রচণ্ড হামলার তুমুল উদ্বেগপূর্ণ মুহূর্তে বয়ানের কুরআন ছিল আমার শ্রেষ্ঠতম সঙ্গী। যখন-তখন বিমান হামলার উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে বয়ানের কুরআন আমাকে পরম নিশ্চিন্তে ভূগর্ভের বাংকারে প্রতীক্ষার প্রহর কাটাতে সাহায্য করত। যে কোনও সময় মার্কিন স্নাইপারদের টার্গেটে পরিণত হওয়ার অনিশ্চিত সময়েও বায়ানের কুরআন যোগাত পরম আশ্বাস!

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ কুরআনি ‘বাছুর’! □□

-

গতকাল আমাদের মাদরাসার ইফতিতাহী দরস (বছরের প্রথম ক্লাস) হয়েছে। তালিবে ইলমদের কুরআন কারীমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে, কথাপ্রসঙ্গে একটা দৃশ্যকল্প মাথায় এল। দশ মিনিট ধরে যা বোঝাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম, দৃশ্যকল্পটার সাহায্যে সহজেই বোঝানো সম্ভব হয়েছে,

১: গাভীর দুধ দোহন করার দৃশ্যটা আমাদের চোখের সামনেই আছে। রাতের বেলা বাছুর বেঁধে রাখা হয়। যাতে দুধ গাভীর ওলানে জমা হয়ে থাকে। গাভীর ওলানের আল্লাহর অপূর্ব নেয়ামত রেখে দেয়া আছে, ঠিক তেমনি কুরআন কারীমেও ইলমের সাগর জমা করা আছে।

২: সকালে দুধ দোহন করার সময় বাছুরকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাছুরটা ছুটে এসে মায়ের ওলানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাগলের মতো চুকচুক করে দুধ পান করতে শুরু করে। বেরসিক মালিক তখন বাছুরকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে আলাদা করে অদূরে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখে। এবার ছ্যাঁ ছোঁ করে দুধ দোহন করতে শুরু করে।

৩: দুধ দোহন করার আগে বাছুরকে মায়ের ওলানে একটুখানি দুধ খেতে দেয়ার কারণ হল, বাছুর বৎসল গাভী অদ্ভুত উপায়ে ওলান থেকে দুধ উঠিয়ে রাখে। মালিক দুধ দুইতে গিয়ে দুধ পায় না। বাছুর মুখ দিলে মাভী (মা+গাভী) দুধ ছাড়ে।

৪: ছেলেবেলায় দীর্ঘদিন গো-পালন ও গো-চারনের কাজে থাকতে হয়েছিল। আমাদের একটা গাভী ছিল বেশি চালাক। দুধ দোহনের আগে, বাছুর মুখ দিলে দুধ ছাড়তো। বাছুর বেঁধে রাখলে সাথে সাথে দুধ উঠিয়ে নিত। বাঁট ধরে শত টানাটানি একফোঁট দুধ বের হত না। ভারি মুশকিল! কী করা যায়? আম্মু একটা বুদ্ধি বের করে ছিলেন। বাছুর বাঁধার আগে, করতেন কি, একটা ভেজা চুপচুপে কাঁথা গো-মাতাজির পিঠে চাপিয়ে দিতেন। আর যাবে কোথায়। ঠাণ্ডা ও চাপের কারনেই হোক বা অন্য কোনও কারণে হোক, গরুজি দুধ উঠিয়ে নিতে পারতেন না।

৫: ওলানে দুধ নামাতে হলে, বাছুর লাগে। কুরআন কারীমে সুপ্ত থাকা ইলম নামাতে হলেও আরবী ভাষা আগে। মেহনত লাগে। চর্চা লাগে।

৬: বাছুরকে মায়ের ওলান থেকে পৃথক করতে চাইলে, বাছুর যেমন আরও মরিয়া হয়ে রশি ছিঁড়ে, মায়ের ওলানের দিকে ছুটে যেতে চায়, আমাদেরও এমন হওয়া উচিত। যত বাধাই আসুক, আমরা সব বাধাবিঘ্ন দলে কুরআন কারীমের দিকে ছুটে আসব।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ দুনিয়ার ঠাটঠমক! □□

-

✍ ১: আমাদের হুজুর তখন লাহোরে পড়াশোনা করেন। প্রতি রমযানে তাফসীর পড়ার জন্য মুফতি হাবীবুল্লাহ সাহেবের কাছে যান। একদিন তারাবীহের পর দাওয়াত ছিল। লাহোর শী‘আ অধ্যুষিত শহর। রমযান উপলক্ষ্যে তারা হরেকরকমের সাজসজ্জা করে। রঙিন ফানুস, তারাবাতি দিয়ে পুরো শহরকে আলোকসজ্জিত করে তোলে। হুযুর বললেন,

-হুযুরকে নেয়ার জন্য মেযবান গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। আমাকেও হুযুরের সাথে কারে উঠতে বললেন। কার চলছে। রমযানের মধ্যদশকের রাত। ঈদের আগমনি রেশ চারদিকে। জমজমাট বাজারে রমরমা আয়োজন। দুনিয়ার দুর্নিবার আকর্ষণে ছুটে আসছে ‘লাহোরীরা’। আমাদের গাড়ি ছুটে চলছে গন্তব্য পানে। হুসহাস পাশ কাটাচ্ছে উচ্ছল গাড়িঘোড়া। রমযানের পবিত্রতা ছেদ করেই কাউয়ালির তাকদিনাধিনের উদ্দাম উচ্ছ্বাস চলছে। আমি অভিভূতের মতো গাড়ির শার্সি দিয়ে তাকিয়ে আছি লাহোরের লহরিলীলার দিকে। মুফতি সাহেব হুজুর আমার চোখের মুগ্ধদৃষ্টি দেখে নিন্মোক্ত আয়াতটা তিলাওয়াত করলেন।

✍ ২: আমাদের প্রফেসর হযরতের মধ্যেও এই আয়াতের প্রতি বিশেষ টান দেখেছি। একদিন তারাবীহ পড়ে হযরতের দরবারে বসে আছি। এক যুবক দেখা করতে এল। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাবে। কিছু নসীহত চাইল। হযরত এই আয়াত পড়লেন,

وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَىٰ مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ ۚ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَىٰ

۞ আপনি পার্থিব জীবনের ওই চাকচিক্যের দিকে চোখ তুলে তাকাবেন না, যা আমি তাদের (অর্থাৎ কাফেরদের) বিভিন্ন শ্রেণিকে মজা লোটার জন্য দিয়ে রেখেছি, তা দ্বারা তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। বস্তুত আপনার রব্বের রিযক সর্বাপ্রেক্ষা উত্তম ও সর্বাধিক স্থায়ী (তোয়াহা ১৩১)।

✍ ৩: মাঝে মধ্যে দুনিয়ার মোহ পেয়ে বসে। চারপাশের চাকচিক্যময় জীবন দেখে, চোখ ধাঁধিয়ে যেতে চায়। বড়লোক আত্মীয়ের ঠাটবাট-ঠাটঠমক দেখে, কখনো সখনো মনে চায়, অকিঞ্চিৎকর দুনিয়াকে চেখে দেখতে ইচ্ছে হয়, তখন আয়াতটা সামনে চলে আসে। কুরআনী নূরের ছটায়, দুনিয়ার জুলমত (অন্ধকার)-এর ‘ওয়াসওয়াসা’ আস্তে আস্তে মিইয়ে যেতে থাকে।

✍ ৪: যখনই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার ফাঁপা খোলস দেখে, ভেতরে বিষাক্ত ‘বাস্প’ জমার উপক্রম হয়, মনে মনে আউড়ে নিই, আল্লাহর দেয়া রিযিকই (خَيْرٌ وَأَبْقَىٰ) সর্বাপেক্ষা উত্তম ও সর্বাধিক স্থায়ী। চোখের ঘোর কেটে যায়।

✍ ৫: আজ একজন তালিবে ইলম ভর্তি পরীক্ষা দিতে এল। আমি এই আয়াত নিয়েই ভাবছিলাম। তাকে নিজের পছন্দমত তিলাওয়াত করতে বললাম। অবাক করা ব্যাপার, সে এই আয়াতই তিলাওয়াত করল। চমকে উঠলাম। আল্লাহ তা‘আলা প্রায়ই নানাভাবে সময়োপযোগী আয়াত সামনে হাজির করে দেন।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ ক্ষমা ও দয়া! □□

-

✍ দুনিয়াতে গুনাহমুক্ত থাকা অসম্ভব। নবীগন ছাড়া আর কেউই নিষ্পাপ নয়। আল্লাহ চাইলে যে কাউকে মাফ করে দিতে পারেন। যে কারো প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে পারেন। যেমনটা সাহাবায়ে কেরামের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। দুনিয়াতে যেসব বিপদদাপদ আসে, আমাদের কৃতকর্মের কারণেই আসে,

وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ

۞ তোমাদের যে বিপদ দেখা দেয়, তা তোমাদের নিজ হাতের কৃতকর্মেরই কারণে দেখা দেয়। আর তিনি তোমাদের অনেক কিছুই (অপরাধ) ক্ষমা করে দেন (শুরা ৩০)।

✑ ১: আয়াতে বলা হয়েছে (مِّن مُّصِیبَة) অর্থাৎ ছোট বা বড় যে কোনও মুসীবতই আসুক, আমাদের পাপের কারণেই আসে।

✑ ২: প্রথম অংশ ভীষণ ভয় ধরিয়ে দেয়। কিন্তু পরের অংশই মনের উপর সান্ত¡নার প্রলেপ বুলিয়ে দেয় (وَیَعۡفُوا۟ عَن كَثِیر) অনেক অপরাধ ক্ষমা করে দেন।

✑ ৩: আমার উপর বালা-মুসীবত যা আসে, সবই আমার বেশিরভাগ গুনাহ মাফ করে দেয়ার পর, অল্পকিছু গুনাহের কারণেই আসে। তারপরও আমি কত হাহুতাশ করি। ভেঙে পড়ি। আল্লাহর প্রতি অভিযোগ দায়ের করতে থাকি। অথচ অনেক পাপ যে তিনি অগোচরেই ক্ষমা করে দিয়েছেন, সেকথা মনে রাখি না।

✑ ৪: আল্লাহ দুনিয়াতে আমাকে অল্পকিছু গুনাহের জন্য পাকড়াও করেছেন, বিপদ দিয়েছেন, আবার আখেরাতেও ধরবেন? তিনি তো রহীম। তিনি রহমান।

✑ ৫: দুনিয়াতে আমার অনেক গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। আখেরাতেও কি অনেক গুনাহ মাফ করে দেবেন না? অল্পকিছু গুনাহের জন্য পাকড়াও করবেন? তিনি তো ওয়াদূদ। তিনি রঊফ।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ নবীজির আদর্শ! □□

-

✍ সর্বোত্তম আদর্শ কোনটি? নবীজি সা.-এর সুন্নাহ। আর কোনও কিছু নবীজির রেখে যাওয়া শিক্ষার সাথে তুলনীয় হতে পারে না। ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত প্রায় প্রতিটি গোষ্ঠীই নবীজির আদর্শ অনুসরণের কথা বলে। সে আদর্শ কেমন?

مَا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ مِنْ أَهْلِ الْقُرَىٰ فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ ۚ وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ

۞ আল্লাহ তাঁর রাসূলকে জনপদবাসীদের থেকে ‘ফায়’ হিশেবে যে সম্পদ ‘ফায়’ হিশেবে দিয়েছেন, তা আল্লাহর, তাঁর রাসূলের, (রাসূলের) আত্মীয়বর্গের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের ও মুসাফিরদের প্রাপ্য, যাতে যে সম্পদ তোমাদের মধ্যকার কেবল বিত্তবানদের মধ্যেই আবর্তন না করে। রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর আর তোমাদেরকে যা থেকে নিষেধ করেন তা হতে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় করে চল। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা (হাশর ৭)।

✍ নবীজির আনীত আদর্শ আমাদেরকে গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। আমরা আসলেই কি নবীজি আদর্শ পুরোপুরি গ্রহণ করি?

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا

۞ বস্তুত রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ, এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে (আহযাব ২১)।

✍ উপরোক্ত দুই আয়াত জিহাদ-কিতালের প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে। দু’টি আয়াতেরই মূলবার্তা: নবীজির ইত্তেবা (অনুসরণ) উম্মতের উপর ওয়াজিব (অত্যাবশ্যক)। যারা নবীজির সুন্নাতের অনুসারী হওয়ার দাবি করে থাকেন, তারা কোন ধরনের সুন্নত পালন করেন? আমি কি সূরাতুল কিতাল (মুহাম্মাদ) আনফাল ও তাওবায় বর্ণিত সুন্নাতের কথা ভেবেছি? নাকি শুধু খাবার-দাবার, ঘরদোরের মিঠি মিঠি সুন্নত পালন করেই ‘মহিউস সুন্নাহ’ হয়ে বসে আছি? নবীজি দু‘আ করে গেছেন,

اللَّهمَّ اجعلْ فَناءَ أمَّتي قتلًا في سبيلِك بالطَّعنِ والطّاعونِ

☞ হে আল্লাহ! আপনার রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় নিহত করে, আমার উম্মতের বিনাশসাধন করুন। এবং বসন্তরোগের (মহামারির) মাধ্যমে উম্মতের বিনাশ সাধন করুন (আবু বুরদাহ রা. আহমাদ ১৫৬৪৬)।

➨ ১: কারো কারো মতে, এখানে উম্মত বলে সাহাবায়ে কেরাম উদ্দেশ্য। কারণ তাদের বেশির ভাগই মারা গেছেন শহীদ হয়ে। আর বিপুলসংখ্যক সাহাবী মারা গেছেন আমওয়াস ও অন্যান্য মহামারীতে।

➨ ২: কারো মতে, এটা দু‘আ ছিল না, আগামসংবাদ প্রদান করা উদ্দেশ্য। উম্মাহর সেরা প্রজন্মের ক্ষেত্রে সংবাদের সত্যতা প্রতিফলিত হয়েছে।

➨ ৩: যাই হোক, নবীজি তার উম্মতের জন্য শাহাদাতের মৃত্যুর দু‘আ করে গেছেন। আমরা সুন্নাতের পাবন্দ হওয়ার দাবিদার, তারা কি নবীজির জিহাদী আদর্শ লালনে সক্রিয় ভূমিকা রাখি?

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ তাহাজ্জুদের ‘ঘণ্টা’ □□

-

✍ আমাদের দায়িত্ব ছিল তাহাজ্জুদের জন্য সবাইকে ডেকে দেয়া। ছোট্ট একটা পেতলের ঘণ্টি ছিল। মাদরাসাময় ঘুরে ঘুরে সেটা ঠন ঠন করে বাজাতে হত। কিছু কামরার তালিবে ইলমরা বেশি অলসতা করত। উঠতে চাইত না। তারা না ওঠা পর্যন্ত ঘণ্টা বাজিয়েই যেতে হত। এমনকি দরজা খুলে তাদের কানের কাছে গিয়ে একনাগাড়ে ঢং ঢং চলত। কানের পোকামাকড়ের গুষ্টিশুদ্ধ পালাতে দিশে পেত না। দুষ্ট কেউ ঘণ্টা বাজানোর দায়িত্বে থাকলে, ঘুম ভাঙা পর্যন্ত ঘণ্টা বাজানো তো চলতই, ছেলেটি কানের কাছে ঘণ্টাধ্বনির জ¦ালায় অস্থির হয়ে, দৌড়ে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ত। তার পিছু পিছু ছুটত ঘণ্টাবাধকও। একেবারে ‘হাম্মামের’ দরজা পর্যন্ত হাঁকিয়ে তবে ক্ষান্ত হত। এভাবে তাড়া খেয়ে ভয়েও কেউ ঘুমিয়ে থাকার সাহস পেত না। কোনও কামরা একদিন উঠতে দেরি করলে, পর দিন থেকে সে কামরাতেই সবার আগে ঘণ্টাহামলা চালানো হত। এসব কারণে তাহাজ্জুদ পড়াটাও আনন্দজনক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। তবে শয়তান থাবা বসাত ঘণ্টাবাধকদের উপর। ফাঁকিবাজ কেউ ঘণ্টার দায়িত্বে থাকলে, তারা করত কি, সবাইকে জাগিয়ে দিয়ে, নিজেরা নিরাপদ জায়গা দেখে ঘুমিয়ে পড়ত।

☞ ধরা পড়ে যেতে সময় লাগল না। যথারীতি হুজুরের কাছে বিচার গেল। ফজরের পর মসজিদে বিচারসভা বসল। হুজুর মুচকি হেসে ঘুমের খোঁজ-খবর নিলেন। কোথায় কোথায় ফাঁকি দিয়ে ঘুমুনো হয়, তার সুলুক-সন্ধান বের করলেন। তারপর বললেন,

-আল্লাহ তোদের কথা কুরআন বলেছেন জানিস তো?

আমরা অবাক। বলেন কি হুজুর! আমাদের কথা কুরআনে আসবে কী করে? হুজুর তিলাওয়াত করলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ

নিচের জামাতের তালিবে ইলম। তখনো আরবী বোঝার যোগ্যতা হয়নি। হুজুর তরজমা করে দিলেন,

۩ হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না? (সাফ্ফ ২)

✑ সবাইকে ডেকে দিয়ে, নিজেরাই ঘুমিয়ে পড়িস? তোদের কাজটা আল্লাহর পছন্দ হয়নি। আল্লাহকে নারাজ করে, আলিম হবি কী করে? এবার থেকে যখনই ফাঁকি দিতে ইচ্ছে করবে, আয়াতটা মনে মনে কয়েকবার পড়ে নিবি। আর কোনও আমল অন্যকে করতে বললে, নিজেও করার চেষ্টা করবি। তাহলে বলাতেও বরকত আসবে। করাতেও বরকত আসবে।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

আলহামদুলিল্লাহ!

-

সূরা কাহফের মূল বার্তা কী?

সূরার শুরুর শব্দটাই হতে পারে মূল বার্তা।

কুরআন বলছে, প্রথম শব্দটাকেই জীবনের মূল বার্তা বানিয়ে নাও

১: দ্বীন নিয়ে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার কষ্টে দেশদশ ছেড়ে সংকীর্ণ গুহায় আশ্রয় নিতে হলেও ‘আলহামদুলিল্লাহ’!

২: যুলকারনাইনের মতো পূর্ব-পশ্চিমের বাদশাহ বনে গেলেও ‘আলহামদুলিল্লাহ’!

৩: বাগান মালিকের মতো অহংকারী বড়লোক বন্ধুর সঙ্গে থেকে অপমানজনক কথাবার্তা সইতে হলেও ‘আলহামদুলিল্লাহ’!

৪: খিযিরের মতো মহান বিনয়ী নেককারের সঙ্গ পেলেও ‘আলহামদুলিল্লাহ’!

সর্বাবস্থায় ‘আলহামদুলিল্লাহ’!

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

বাবার দাফনের কাজ সম্পন্ন। সবাই চলে গেছে। ছেলেটা একাকী বাবার কবরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলছে,

-আব্বু, আপনি কি প্রতি রাতে সূরা মুলক তিলাওয়াতের ব্যপারে রবের ওয়াদা সত্য পেয়েছেন?

বাবাভক্ত ছেলে এবার আকাশের তাকিয়ে অশ্রুসজল চোখে বলল,

ইয়া রাব্বাহ! আমাদের নবীজি সা. বলে গেছেন, প্রতি রাতে সূরা মুলক তিলাওয়াত করলে, আপনি কবরের আযাব মাফ করে দেবেন।

ইয়া রাব্বাহ! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমার আব্বুকে কখনো সুরা মুলক তিলাওয়াত করা ছাড়া ঘুমুতে যেতে দেখিনি।

কবর দিতে আসা আত্মীয়-স্বজন অবাক হয়ে দেখল, ছেলেটা চোখের পানি মুছতে মুছতে হাসিমুখে কবরস্থান ত্যাগ করছে আর বলছে,

-আমার এত চিন্তার কী আছে? নবীজির হাদীস মিথ্যা হতেই পারে না। সুরা মুলকই আব্বুকে এখন রক্ষা করবে। সূরা মুলক যার সঙ্গী, তার কবরজীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগা ঈমানবিরোধী কাজ।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ খুশির খবর! □□

১: রমাদান অফুরন্ত খাইর ও কল্যাণের মাস। বরকতের মাস। সীমাহীন ফযীলতের মাস। অঢেল প্রাপ্তির মাস। মুমিন বান্দাগন পুরো বছর ধরে এই মাসের প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে প্রহর গোণে। অন্য মাসের তুলনায়, এই মাস তুলনামূলক দ্রুত কেটে যায়।

২: এই মাস পেয়ে মুমিনগন সুখী হন। খুশি হন। এই মাসের সিয়াম-কিয়াম মুমিন বান্দাকে সুখী আর খুশি করে। রমাদ্বানের ইবাদত সুখ ও সৌভাগ্যের বার্তা নিয়ে আসে। রহমত মাফিরাতের এই ধারা দুনিয়া ছাড়িয়ে আখেরাত পর্যন্ত অব্যহত থাকে।

৩: রমাদানের শুরুতে, রমাদানের ফয়েজ-বরকত নিয়ে একে অপরের সাথে আলোচনা-মুযাকারা করা সুন্নাত। আনাস রা. বলেছেন,

دخل رمضانُ فقال رسولُ اللهِ ﷺ إنَّ هذا الشَّهرَ قد حضركم وفيه ليلةٌ خيرٌ من ألفِ شهرٍ من حُرِمها فقد حُرم الخيرَ كلَّه ولا يُحرمُ خيرَها إلّا محرومٌ

রমাদ্বান এলে আল্লাহর রাসূল সা. বললেন, এই মাস তোমাদের কাছে হাজির হয়েছে। এই মাসে একটি রাত আছে, যা হাজার রাতের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এই রাতের ‘খাইর’ থেকে বঞ্চিত হবে, সে (প্রকারান্তরে) সমস্ত খাইর থেকেই বঞ্চিত হবে। (নিতান্ত) মাহরুম-হতভাগা ছাড়া আর কেউ এই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হত পারে না (ইবনে মাজাহ ১৬৪৪)।

৪: সুখের সাথেই থাকে দুঃখ। সৌভাগ্যের সাথে থাকে দুর্ভাগ্য। রমাদান কারো জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনলে, কারো কারো জন্য দুর্ভাগ্যও বয়ে আনে। আমি সৌভাগ্যবান হবো নাকি, দুর্ভাগা হব, সেটা আমার ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে।

৫: রমাদান মুমিনের ব্যবসার মাস। অল্পপুঁজিতে বেশি মুনাফার মাস। স্বল্প ইবাদতে বেশি সওয়াবের মাস। আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন,

إذا كان أولُ ليلةٍ من شهرِ رمضانَ صُفِّدَتِ الشياطينُ ومَرَدةُ الجنِّ، وغُلِّقتْ أبوابُ النارِ فلم يُفتحْ منها بابٌ، وفُتِّحَتْ أبوابُ الجنةِ فلم يُغلقْ منها بابٌ، ويُنادي منادٍ كلَّ ليلةٍ: يا باغيَ الخيرِ أقبلْ، ويا باغيَ الشرِّ أقْصرْ، وللهِ عتقاءُ من النارِ، وذلك كلَّ ليلةٍ

প্রতিবছর রমাদান বান্দার কাছে কিছু নিদর্শন আর হাদিয়া নিয়ে হাজির হয়,

১: রমাদানের প্রথম রাত থেকেই শয়তান ও দুষ্ট জি¦নদের শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। যাতে তারা রোযাদারের মনে কুমন্ত্রণা দিতে না পারে

২: জাহান্নামের দরজসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। একটি দরজাও খোলা রাখা হয় না। মন্দকর্মের উপায়-পদ্ধতি সংকুচিত করে দেন। জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। একটি দরজাও বন্ধ রাখা হয় না। সৎকর্মের উপায়-পদ্ধতি বাড়িয়ে দেন।

৩: প্রতি রাতেই এক ঘোষক ঘোষণা দেয়, হে কল্যাণকামী, এগিয়ে এসো। হে অকল্যাণকামী, ক্ষান্ত হও।

৪: আল্লাহ তা‘আলা বহু জাহান্নামীকে মুক্তি দেবেন। প্রতি রাতেই এমন ঘটতে থাকবে।

.

৬: আমরাও পারি নবীজি সা.-এর সুন্নাত হিশেবে, পারিবারের সাথে, বন্ধু-বান্ধবের সাথে, শাগরিদ-শিষ্যের সাথে রমাদানের কল্যাণকর দিক নিয়ে আলোচনা করতে পারি।

.

৭: আলোচনার দ্বানা দু’টি উপকার। সুন্নাত আদায় হল। অন্যকে বলার দ্বারা নিজেরও আমলের সুযোগ হল। অন্য কেউ আমার কাছ থেকে শুনে আমল করলে, তার সওয়াবের ভাগ আমি পাবো।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

দ্বীন বিক্রি!

-

বনী ইসরাঈলের আলিমগণ অল্পমূল্যে দ্বীন বিক্রি করে দিয়েছিল। বর্তমানে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। কিছু মানুষ কোনও মূল্য ছাড়াই দ্বীন বিক্রি করে দিয়েছে। বিক্রি করে দিচ্ছে। প্রতি যুগেই কিছু লোক থাকে, যারা অল্পমূল্যে, নামমাত্র মূল্যে বা কোনও মূল্য ছাড়াই দ্বীন বিক্রি করে দেয়। এই বিক্রেতাদের জানা নেই, আল্লাহ তা‘আলা তার দ্বীন সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন। এসব ব্যবসায়ীরা আসলে তাদের নিজস্ব দ্বীন বিক্রি করে। আল্লাহর দ্বীন নয়। এদের দ্বীন ব্যবসায়, আল্লাহর দ্বীনের কোনও ক্ষতি হয় না। ক্ষতি হতে পারে না।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ গৃহে অবস্থাননীতি! □□

(০৮-০৫-১৯)

-

১: কুরআন কারীম আমাদের সংবিধান। নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য। কুরআন বলছে, পুরুষ জীবিকার উদ্দেশ্যে বাইরে যাবে, নারী ঘরেদোর সামলাবে। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া নারী বাইরের কাজে জড়াবে না।

২: মুসলিম নারী ঘরে অবস্থান করবে কিভাবে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীমে এ ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন,

وَقَرۡنَ فِی بُیُوتِكُنَّ

তোমরা নিজগৃহে অবস্থান কর (আহযাব ৩৩)।

৩: আয়াতে বর্ণিত (قَرۡنَ) ক্বরনা ক্রিয়াটি, ইলমুল ক্বিরাতের আলিমগন দুইভাবে পড়েন।

ক: ইমাম নাফি, ইমাম আসিম ও ইমাম আবু জা‘ফর রহ. পড়েন ‘ক্বরনা’ (قَرۡنَ)। আমরা তাদের মতোই পড়ি। এই ক্রিয়াটি (قَرار) শব্দমূল থেকে উদ্ভুত হয়েছে। স্থির থাকা। অবস্থান করা। সুস্থির হওয়া। তোমরা তোমাদের ঘরে সুস্থির হয় অবস্থান কর। প্রয়োজন ছাড়া বের হয়ো না।

খ: ইলমুল কিরাতর বাকী আলিমগন ক্রিয়াটিকে পড়েছেন (قِرۡنَ) ক্বিরনা। এই ক্রিয়াটি (وَقَار) শব্দমূল থেকে উদ্ভুত হয়েছে। ভাবগাম্ভীর্য। সম্মান। সমীহ জাগানিয়া আচরণ। তোমরা ভাবগাম্ভীর্যের সাথে গৃহ অবস্থান কর। সম্মান ও সমীহ জাগানিয়া আচরণের সাথে গৃহে অবস্থান করো। যাতে দুষ্ট পুরুষও তোমার আচরণ দেখে সম্মান জানাতে বাধ্য হয়।

৪: প্রথম কেরাতে নারীকে গৃহে অবস্থানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় কেরাতে নারীকে গৃহে অবস্থানের ধরন সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দুই কেরাত মিলিয়ে অর্থ দাঁড়াল (قَرَارٌ بِوَقَارٍ)। ভাবগাম্ভীর্য ও সম্মানের সাথে অবস্থান।

৫: আম্মাজান সাওদা রা.-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল,

-আপনি ঘর থেকে বের হন না কেন?

-আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ঘৃহে অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছেন। আমি কিভাবে নির্দেশ অমান্য করে বের হই?

৬: আয়েশা রা. এই আয়াত পড়ার সময় কাঁদতে শুরু করতেন। জামাল যুদ্ধে আলী রা.-এর বিপরীতে হওয়ার কারণে আফসোস করতন।

৭: ওয়াকার (وَقَار) শব্দটি অনেক অর্থবহ। শব্দটির যথাযথ বাংলা প্রতিশব্দ আছে কি না জানা নেই।

ক: উচ্চ আওয়াজে কথা বলা ওয়াকার বা ভাবগাম্ভীর্যবিরোধী আচরণ।

খ: অন্যের গীবত করা, অন্যের সাথে ঝগড়া করা, অহেতুক রাগ দেখানো, অপ্রয়োজনীয় কাজ করা ওয়াকার বা ভাবগাম্ভীর্যবিরোধী আচরণ।

গ: পরপুরুষের সাথে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা, ওয়াকারবিরোধী আচরণ। সন্তানকে অহেতুক বকাবকি করা, স্বামীর সাথে তর্কে লিপ্ত হওয়া ‘ওয়াকার’ বিরোধী আচরণ।

ঘ: ঘরে অবস্থান করে, বেগানা পুরুষের সাথে ঝগড়া বাঁধানো, মুসলিম নারীর স্বভাব হতে পারে না। আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মুসলিম নারী, পরপুরুষের সংশ্রব সর্বান্তকরণে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। জীবনের তাকিদে বা শিক্ষার প্রয়োজনে শরীয়তের সীমায় থেকে প্রশ্ন হতে পারে।

ঙ: আয়াতটি উম্মুল মুমিনীন সম্পর্কে নাযিল হলেও, সমস্ত মুসলিম নারী এই হুকুমের আওতায় আসবে।

৮: ঘরে অবস্থান করা হল, ওয়াকার বজায় রাখা হল না, তাহলে আয়াতের অর্ধেকের উপর আমল হল। বাকি অর্ধেক ছুটে গেল।

৯: আমরা নফল ইবাদত বা সুন্নত মুস্তাহাবগুলোর কথা জানি। সচেতনভাবে আমল করি। এসব ইবাদতের ফযীলত সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখি। কিন্তু কুরআনি আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা রাখি না।

১০: আত্মসম্মানের সাথে গৃহে অবস্থান করা কুরআনি নির্দেশ। বেশিরভাগ মুসলিম নারীই ঘরে অবস্থান করেন। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে আসেন না। এমনকি বেশিরভাগ মুসলিম নারী ‘ওয়াকারবিরোধী’ আচরণ করেন না।

১১: প্রতিটি আমলের জন্য নিয়্যত অপরিহার্য। নিয়ত না থাকলে, সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতও আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না।

১২: কুরআনের ভাষ্য মতে মুসলিম নারীর গৃহে অবস্থান করা একটি স্বতন্ত্র ‘ইবাদত’। সচেতন নিয়্যাতে গৃহে অবস্থান করলে, প্রতিটি মুসলিম বোন, ছোট-বড় সবাই অনেক বড় ইবাদতের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেন।

১৩: কিছু ইবাদত সাময়িক। সময়সাপেক্ষ। যেমন পাঁচওয়াক্ত ফরয নামাজ। কিছু ইবাদত সার্বক্ষণিক। যেমন পুরুষের দাঁড়ি। নারীর গৃহে অবস্থান। মুসলিম সচেতন নিয়্যাতে ঘরে অবস্থান করলে, সারাক্ষণ ইবাদতের সওয়াব পেতে থাকবেন।

১৪: যারা নিতান্ত প্রয়োজনে বাইরে বের হন, তারাও বাকি সময়টুকু নিয়্যাত করতে পারি, আমি আল্লাহর হুকুম পালনার্থে গৃহে অবস্থান করছি। তাহলে ঘুমের সময়টাও ইবাদতের আওতায় চলে আসবে।

১৫: আমলের কথা মনে হলে, আমরা হাদীসের দিকে নজর দেই। এটাই সাধারণ প্রবণতা। কিন্তু কুরআনেও আমল আছে। ইবাদত আছে। গৃহে অবস্থানও তেমন এক ইবাদত।

১৬: মেয়েসন্তানকে ছোটবেলা থেকেই এই আয়াতের সাথে পরিচিত করে দিতে পারি। তার মানসে বসিয়ে দিতে পারি, সে ভাইয়ের মতো বাইরে খেলতে যাচ্ছে না, মায়ের সাথে ঘরে থাকছে, এটা কুরআনের নির্দেশ মেনেই করছে। মায়ের সাথে থাকার কারণে, সে সারাক্ষণ কুরআনি ইবাদতে মশগুল আছে। প্রতিনিয়ত সে সওয়াব পাচ্ছে। কন্যাশিশুকে ছোটবেলা থেকেই সচেতন নিয়্যাতের সাথে এই ইবাদতে অভ্যস্ত করে তোলা মা-বাবার অবশ্য কর্তব্য।

১৭: ওয়াকার ও কারার। দু’টি বিষয়। একজন নারীর উভয় বৈশিষ্ট্য অর্জনে পুরুষের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পুরুষের সক্রিয় ও সচেতন সহযোগিতা ছাড়া, এ-দু’টি বৈশিষ্ট্য অর্জন করা নারীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। নারী যাতে ঘরে অবস্থান করতে পারে, নারী যাতে সম্মান ও সমীহবোধ নিয়ে ঘরে থাকতে পারে, এটা নিশ্চিত করা পুরুষেরই অবশ্যকর্তব্য।

১৮: নারী ঘরে অবস্থান করল। সম্মান ও সমীহবোধ বজায় রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু পুরুষ নারীকে কষ্ট দিয়ে উত্যক্ত করতে থাকলে, আয়াতের উপর আমল করা নারীর জন্য অসম্ভব হয়ে যাবে। নারীকে পরিপূর্ণভাবে এই আয়াতের আমলে উঠিয়ে আনতে হলে, বাড়ির পুরুষকেই সক্রিয় হতে হবে।

১৯: নারী গৃহে অবস্থান করার মানে এই নয়, জীবনেও ঘর থেকে বের হবে না। নারী নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হবে না, নারীর প্রধান কর্মক্ষেত্র হবে ঘর, এটাই আয়াতের মূল উদ্দেশ্য।

২০: কুরআন বলে নারী ঘরে থাকুক। কুফরি বিশ^ব্যবস্থা বলে নারী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসুক। নারীর বিয়ের বয়েস বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করে, একজনের আয়-রোজগারে সংসার চালানো কঠিন করে তোলা হয়েছে, কিছু অমানুষ পুরুষের নির্যাতনকে ফলাও করে প্রচার করে, নারীর মনে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করা হয়েছে।

২১: মিডিয়ার মাধ্যমে পুরুষের প্রতি অনাস্থা তৈরি করে, নারীকে চাকুরির প্রতি আগ্রহী করে তোলা হয়েছে। ব্যক্তিগত সঞ্চয় বা নিজের চাকুরি না থাকলে, শেষজীবনে পথের ভিখারী হতে হবে, এমন আশংকা সৃষ্টি করা হয়েছে।

২২: প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার ফাঁদ পেতে, নারীর সবচেয়ে সুন্দর সময়টাকে উষর করে তোলা হয়েছে। ডিগ্রিসর্বস্ব শিক্ষাকে লোভনীয় করে তুলে, নারীকে বিয়েবিমুখ করে তোলা হয়েছে।

২৩: কর্মমুখী করে নারীকে সংসারবিমুখ করে তোলা হয়েছে। স্বামী-সন্তান-সংসারকে অপমানজনক করে তোলা হয়েছে। চাকুরিকে স্বাধীনতা ও মুক্তির মূল সোপানে পরিণত করা হয়েছে।

২৪: এমন এক গোলকধাঁধা তৈরি করা হয়েছে। স্বামী তার স্ত্রীকে সবসময় কাছে পায় না, সন্তানও যখন তখন মায়ের আদর পায় না। স্বামী ও সন্তান বহির্মুখী হয়ে পড়ে। তৈরি হয় দূরত্ব আর অনাস্থা।

২৫: উচ্চশিক্ষা বলতে, কিছু উচ্চডিগ্রিকে বোঝানা হয়। এসব ডিগ্রি অনেক সময় নারীর মনে অপ্রয়োজনীয় বাষ্প তৈরি করে। স্বামী-সংসারকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তুচ্ছ আর অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। সময় পেরিয়ে যায়। বিয়ের বয়েস থাকে না। সন্তান ধারনের সোনালী সময় কেটে যায় ডিগ্রির কবলে পড়ে। নারীশিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন। তবে সেটা ডিগ্রিসর্বস্ব নয়, জীবন প্রয়োজনসর্বস্ব হওয়া কাম্য। আর ডিগ্রিসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা শুধু নারীর নয়, পুরুষের জন্যও ক্ষতিকর।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ পরিপূর্ণ রোজা! □□

-

১: সিয়াম মানে কী? মোটাদাগে উত্তর হবে, সুবহে সাদিক থেকে মাগরিব পর্যন্ত পানাহর থেকে বিরত থাকা। কিছু মুমিনের ধারনা, এটুকু হলেই আল্লাহ রোজাদারের প্রতি খুশি হয়ে যাবেন। রোজাও পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।

২: পানাহার বা শারীরিক মিলন থেকে বিরত থাকলে, রোজা ভাঙ্গবে না, কিন্তু শুধু এটুকুতেই রোজা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে, এমন ধারনাও ঠিক নয়। রোজা একটি সামষ্টিক ইবাদত।

৩: রোজা পূর্ণতায় পৌঁছার জন্য বেশ কিছু শর্ত ও আদব আছে। সেসব রক্ষা না করলে, রোজা হালকা হয়ে যায়। আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন,

رُبَّ صائمٍ ليس له من صيامِه إلا الجوعُ، ورُبَّ قائمٍ ليس له من قيامِه إلا السَّهرُ

অনেক রোজাদারের অভুক্ত ক্ষুধার্ত থাকাটাই সার। অনেক তাহাজ্জুদগুজারের রাতজাগাটাই সার (ইবনে মাজাহ ১৬৯০)।

৪: রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলে, গীবত করে, সুদ-ঘুষ খায়, নজরের হেফাযত করে না। এই রোজার কোনও দাম নেই। নিয়্যাত ঠিক না করে, ইখলাসের সাথে তাহাজ্জুদ পড়লেও, রাতজাগা হয় শুধু, কাজের কাজ কিছুই হয় না। আল্লাহ খুশি হন না।

৫: এই হাদীসে প্রধানত দু’টি বিষয়ে তাকিদ দেয়া হয়েছ,

ক: ইখলাস। আমি ইবাদত করছি শুধু আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য। অন্য কাউকে দেখানোর জন্য নয়।

খ: শুধু ইবাদত করলেই হবে না, ইবাদতটিকে বাতিল করে দেয় বা দুর্বল করে দেয়, এমন কার্যকলাপ থেকেও পুরোপুরি বিরত থাকতে হবে।

৬: আল্লাহ তা‘আলা রোজা কেন ফরয করেছেন? আমাদের আখলাক সুন্দর করার জন্য। আমাদের অন্তর্দৃষ্টি আলোকিত করার জন্য। এককথায় বলতে গেলে, আমাদেরকে মুত্তাকি বানানোর জন্য। কুরআনের ভাষায় (لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ) যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয় (বাকারা ১৮৩)।

৭: নিজেকে প্রশ্ন করতে পারি, শুধু ক্ষুধার্ত-অভুক্ত থাকলেই বুঝি ‘তাকওয়া’ অর্জিত হয়ে যাবে? তাকওয়া কি ‘উদর’ দিয়ে হয় নাকি সদর (অন্তর) দিয়ে হয়? তাকওয়া অর্জনের মূলমাধ্যম সদর বা কলব। মুমিনের অন্তর। কলব ঠিক না হলে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাপকাজ থেকে বিরত থাকবে কী করে?

৮: রোজা রেখে প্রথম কাজ হল, কলবকে বাগে আনা। কলবকে পোষ মানাতে পারলে, আমি জবানের হেফাযত করতে পারব, দৃষ্টি সংযত রাখতে পারব, শ্রবণশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুনাহ থেকে বিরত রাখতে পারব।

৯: কলবকে পোষ মানাতে হলে, প্রথমে দৃঢ়সংকল্প করতে হবে। একান্ত খাসদিলে রাব্বে কারীমের দরবারে দু‘আ করে, পাক্কা নিয়্যাত করতে হবে। আল্লাহর কাছে তাওফীক কামনা করে জোরদার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তবেই রোজাবিরোধী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা সম্ভব হবে। আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন,

من لم يدَع قولَ الزُّورِ، والعملَ بِهِ، فلَيسَ للَّهِ حاجةٌ أن يدعَ طعامَهُ وشرابَهُ،

যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ছাড়ল না, অন্যায় কাজ বর্জন করল না, তার পানাহার বর্জনের প্রতি আল্লাহর কোনও আগ্রহ নেই (বুখারী ১৯০৩)।

১০: রোজার প্রধান উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। তাকওয়া কিভাবে অর্জিত হবে? প্রবৃত্তির বিষদাঁত ভেঙে দেয়ার মাধ্যমে। অন্যায় চাহিদাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে, নাফসকে নেকআমলে অভ্যস্ত করে তোলার মাধ্যমে।

১১: তার মানে এই নয়, মিথ্যা বললে, অন্যায় কাজ করলে রোজা ভেঙে যাবে। হাদীসের সারকথা হল, বান্দা রোজা রেখে অন্যায় কাজে জড়ালে, রোজা দুর্বল হবে যাবে। সওয়াব কমে যাবে। আল্লাহর দরবারে এমন রোজার মূল কমে যাবে। রোজা যে সে আমল নয়। আল্লাহ তা‘আলা রোজার আমলকে বিশেষ বিবেচনার দৃষ্টিতে দেখেন। হাদীসে কুদসীতে আছে। আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন,

قالَ اللَّهُ: كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ له، إلّا الصِّيامَ، فإنَّه لي وأَنا أجْزِي به، والصِّيامُ جُنَّةٌ، وإذا كانَ يَوْمُ صَوْمِ أحَدِكُمْ فلا يَرْفُثْ ولا يَصْخَبْ، فإنْ سابَّهُ أحَدٌ أوْ قاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ إنِّي امْرُؤٌ صائِمٌ والذي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بيَدِهِ، لَخُلُوفُ فَمِ الصّائِمِ أطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِن رِيحِ المِسْكِ. لِلصّائِمِ فَرْحَتانِ يَفْرَحُهُما: إذا أفْطَرَ فَرِحَ، وإذا لَقِيَ رَبَّهُ فَرِحَ بصَوْمِهِ.

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, বনী আদমের সব আমলই তার নিজের, শুধু রোজাটা আমার। আমি স্বয়ং রোজার প্রতিদান দেব। রোজা ঢালস্বরূপ। তোমরা রোজা রেখে, অশ্লীল কথা বলবে না, তর্ক-চেঁচামেচি করবে না। কেউ গালি বা লড়াই-ঝগড়া করতে এলে বলবে,আমি রোজাদার। মুহাম্মাদের রবের কসম, রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুবাসের চেয়েও বেশি প্রিয়। রোজাদারের দু’টি আনন্দ: ইফতারের আনন্দ। তার রব্বের সাথে সাক্ষাতের সময় রোজার পুরস্কার লাভের আনন্দ (বুখারী ১৯০৪)।

.

১২: শুধু পানাহার-সহবাস থেকে বিরত থাকলেই রোজা পূর্ণ হয়ে যায় না। উদর আর লজ্জাস্থানের পাশাপাশি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও হারাম আর গুনাহ থেকে বিরত রাখা জরুরী। শুধু তাই নয়, কলব-অন্তরকেও গুনাহ ও হারামমুক্ত রাখা জরুরী।

.

১৩: ইমাম গাযালী রহ. সিয়ামকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করেছেন,

ক: সাধারণের রোজা (صِيام العُموم)। শুধু উদরকে পানাহার আর লজ্জাস্থানকে সহবাস থেকে বিরত রাখে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও কলবকে বিরত রাখে না। হারাম, মিথ্যা, গীবত আর গুনাহেও লিপ্ত হয়।

খ: বিশেষ ব্যক্তির রোজা (صيام الخصوص)। উদর আর লজ্জাস্থানকে প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বিরত রাখার পাশাপাশি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও হারাম-গুনাহ থেকে বিরত রাখে। চোখ-কান-হাত-পা’কে গুনাহে জড়িত হওয়া থেকে বিরত রাখে।

গ: অতি বিশেষের রোজা (صيام خصوص الخصوص)। উদর, লজ্জাস্থান আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পাশাপাশি কলবকেও যাবতীয় পাপ থেকে বিরত রাখে। পাপচিন্তা এলে, নিজেকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।

এটাই সিয়ামের সর্বোচ্চ স্তর। আমার রোজাকে এই স্তুরে উন্নীত করার সাধনায় মশগুল হওয়া উচিত।

.

১৪: প্রথম প্রথম নিজের রোজাকে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করা সম্ভব হবে না। প্রথমে ভেবে বের করতে হবে, আমার রোজার দুর্বল দিকগুলো কী কী। তারপর বুঝেশুনে অগ্রসর হতে হবে।

.

১৫: প্রথম ধাপে চেষ্টা চলতে পারে চোখের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। তারপর মুখের। তারপর কলবের। রাস্তায় বের হলেই চোখের প্রতি তীক্ষè নজর রাখতে হবে। একাকী বসে থাকলে কলবের প্রতি চৌকান্না থাকতে হবে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে আসবে ইন শা আল্লাহ।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ রমাদান কারীম: মাদরাসাতুত তাকওয়া □□

(২২-০৫-১৯)

-

১: রামাদান ঘনিয়ে আসছে। সাথে আসছে ‘সিয়াম’। এমন এক প্রতীক্ষা। এখন রমাদান এসে অর্ধেক চলেও গেছে। সিয়াম ইসলামের চতুর্থ রোকন। স্তম্ভ। রমাদান সম্পর্কে কুরআন কী বলে, সে সম্পর্কে মোটামুটি ধারনা ধাকলে, মানতে সুবিধে হবে।

.

২: ইসলামে জ্ঞানের প্রধান উৎস কুরআন কারীম। সিয়াম সম্পর্কে জানতে হলে, আমরা প্রথমে কুরআনের দ্বারস্থ হতে পারি। বুঝতে সুবিধার জন্য পাশে থাকবে, কুরআন কারীমের শ্রেষ্ঠতম তাফসীর, নবীজির হাদীস শরীফ।

.

৩: সিয়াম (صِيام) অর্থ বিরত থাকা (إمساك)। নিজেকে আটকে রাখা। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা। যদি কারও ধারণা হয়, শরীয়ত কিছু জৈবিক প্রয়োজন থেকে বিরত থাকার শক্তি পরীক্ষার জন্যই ‘সিয়াম’ পালনের বিধান দিয়েছে। এমন চিন্তা, শরীয়তের প্রতি ‘মন্দ’ ধারণার শামিল। আল্লাহ তা‘আলা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বান্দার উপর রোযা ফরয করেছেন। নিছক পানাহার বর্জন, রোযার মূল উদ্দেশ্য হতে পারে না।

.

৪: একটানা পাঁচটি আয়াতে, আল্লাহ তা‘আলা সিয়াম বিষয়ক আলোচনা পেশ করেছেন।

.

৫: প্রথম আয়াত!

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয় (১৮৩)।

.

৬: সিয়ামের প্রধান লক্ষ্য ‘তাকওয়া’। তাকওয়া রোজাদারের কলবে, আল্লাহর আনুগত্যের চেতনা জাগ্রত করে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আগ্রহ তৈরি করে। গুনাহের মাধ্যমে রোজাকে দুর্বল না করার প্রতি সচেতনতা সৃষ্টি করে।

.

৭: মুমিনমাত্রই জানে, আল্লাহর কাছে তাকওয়ার মূল্য কতখানি। প্রকৃত মুমিন সবসময় তাকওয়া অর্জনে সচেষ্ট থাকে। সিয়াম হল তাকওয়ার অর্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। সিয়াম তাকওয়ার বন্দরে পৌঁছার প্রধান সড়ক।

.

৮: সর্বযুগে শরীয়তের প্রতিটি বিধানই, মানুষের জন্য পরিপূর্ণ কল্যাণকর ছিল। সমস্ত নবীর আনীত ও পালিত দ্বীনের নাম ইসলাম ছিল। মৌলিক ইবাদত, উসূলুদ্দীন (দ্বীনের মূলনীতি), আকায়েদ, আখলাক সব ধর্মেই এক ছিল। মৌলিক হারাম বস্তু ও কবীরা গুনাহ যেমন জুলুম, সুদ, নরহত্যা সমস্ত আসমানী ধর্মেই নিষিদ্ধ ছিল। সমস্ত নবীর আনীত দ্বীনের মূলনীতি ও আকীদা এক ছিল। শুধু কিছু শাখাগত মাসয়ালা ও বিধানের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অমিল ছিল।

.

৯: আগের উম্মতের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছিল। আমাদের উপরও ফরয করা হয়েছে। আমরা যেন প্রতিযোগিতা করতে পারি। পূর্ববর্তী কওম থেকে সিয়ামের ইবাদতে অগ্রগামী হয়ে যেতে পারি।

.

১০: আমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত (خَیۡرَ أُمَّةٍ)। আমলেও নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা জরুরী।

.

১১: সিয়াম কঠিন কোনও ইবাদত নয়। আমাদের আগেও এই ইবাদত ছিল। শুধু আমাদের উপরই ফরয করা হয়নি। আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে উৎসাহ দিয়েছেন। অভয় দিয়েছেন।

.

১২: সিয়াম পালন করলে কী হবে? আমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হবে (لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ)। আমরা বিভিন্ন গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারব। কারণ রোজা মানুষের যৌনপ্রবৃত্তিকে অবদমিত করে রাখে। এই প্রবৃত্তির প্ররোচনাতে মানুষ বড় বড় গুনাহের দিকে ধাবিত হয়।

.

১৩: শুরুতে রোজা ফরয হওয়ার কথা বলে, শেষে তাকওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাই রোজাটা হতে হবে কথা ও কাজের পাপমুক্ত।

.

১৪: আল্লাহ তা‘আলার কাছে রোজা অত্যন্ত প্রিয় ইবাদত। তাই সব শরীয়তে রোজার বিধান রেখেছেন। প্রিয় না হলে, এতটা গুরুত্ব দিতেন না।

.

১৫: বান্দার উপর রাব্বে কারীমই সিয়াম পালন ফরয করেছেন। কিন্তু প্রকাশ করেছেন, (كُتِبَ عَلَیۡكُمُ ٱلصِّیَامُ) তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে। এভাবে বলেননি, তোমাদের উপর আমি সিয়াম ফরয করেছি। সিয়াম পালনে বান্দাকে কিছু কষ্ট সহ্য করতে হয়। আল্লাহর তা‘আলা বান্দার কষ্ট হবে, এমন বিধানগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত ‘কর্মবাচ্য’ (মাজহুল) ব্যবহার করেছেন। বান্দার আরাম ও খুশির ক্ষেত্রে কর্তৃবাচ্য (মা‘রুফ) ব্যবহার করেছেন,

كَتَبَ عَلَىٰ نَفۡسِهِ ٱلرَّحۡمَةَۚ

তিনি রহমতকে নিজের প্রতি অবশ্য কর্তব্যরূপে স্থির করে নিয়েছেন (তাই তাওবা করলে অতীতের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেন) আন‘আম: ১২

.

১৬: আল্লাহ তা‘আলা আমাদের উপর সিয়াম ফরয করেছেন। বলেছেন (كُتِبَ عَلَیۡكُمُ ٱلصِّیَامُ)। সাহাবায়ে কেরাম একবাক্যে রাব্বে কারীমের কথা মেনে নিয়েছেন। কোনও কথা বলেননি। প্রশ্ন তোলেননি। মৃদুতম আপত্তিও করেননি। কিন্তু বনী ইসরাঈল কি করল? অন্যায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার কারণে তাদেরকে মুসা আ. বললেন,

إِنَّ ٱللَّهَ یَأۡمُرُكُمۡ أَن تَذۡبَحُوا۟ بَقَرَةࣰۖ

আল্লাহ তোমাদেরকে একটি গাভী যবাহ করতে আদেশ করেছেন (বাকারা ৬৭)।

বনী ইসরাঈল আল্লাহর নবীকে আক্রমণ করে বসল। তারা বলল,

أَتَتَّخِذُنَا هُزُواۖ

আপনি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছেন?

এখানেই শেষ নয়। তাদেরকে বোঝানোর জন্য, মুসা আ.-কে আরও তিনবার আল্লাহর দিকে রুজু হতে হয়েছে।

.

১৭: আমরা চাঁদ দেখে সিয়াম শুরু করি। পূর্ববতীদেরও তাই করতে হত। নিজস্ব বর্ষগণনার মাধ্যমে নয়। ইহুদি খ্রিস্টানরা এখন সৌরবর্ষের গণনা মতে তাদের নিজস্ব ‘উপবাস’ প্রথা পালন করে। কিন্তু কুরআন কারীমে বলা হয়েছে,

كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِینَ مِن قَبۡلِكُمۡ

যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল। অর্থাৎ তাদের মতো হুবহু আমাদের উপরও ফরজ করা হয়েছে। তারা যেভাবে যেভাবে সিয়াম পালন করত, আমাদেরও সেভাবে পালন করতে হবে।

.

১৮: সিয়ামের গুরুত্ব শুধু কুরআন কারীমেই নয়, হাদীসে কুদসিতেও রাব্বে সিয়াম বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন,

كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ له، إلّا الصِّيامَ، فإنَّه لي وأَنا أجْزِي به، والصِّيامُ جُنَّةٌ،

সিয়ামের আমল ছাড়া, আদমসন্তানের প্রতিটি আমল তার নিজের। শুধু সিয়ামই একান্ত আমার নিজের। আমি স্বয়ং সিয়ামের পুরস্কার দেব। অন্য আমল মানুষকে দেখানোর সুযোগ আছে। মানুষের প্রশংসা লাভেরও সুযোগ আছে। সিয়াম বান্দার জন্য গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার ঢালস্বরূপ (আবু হুরায়রা রা.। বুখারি ১৯০৪)।

.

১৯: সব ইবাদতই আল্লাহর জন্য, তবুও সিয়ামের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। সিয়াম পালন করত গেলে সবচেয়ে বড় দু’টি ইন্দ্রিয় লিপ্সাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়,

ক: যৌনচাহিদা।

খ: আহার।

সালাত ছাড়া অন্য কোনও ইবাদতে বান্দাকে এভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণ করে থাকতে হয় না।

.

২০: সিয়াম একটি ক্ষেত্রে সালাতের চেয়েও অনন্য। সিয়াম পালন বান্দা ও তার রবের মাঝে একান্ত গোপন বিষয় হয়ে থাকে। বান্দা প্রকাশ না করলে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সিয়ামের কথা জানা সম্ভব নয়। সালাতসহ বাকি সব বাহ্যিক ইবাদতই বান্দার চোখে পড়ার সম্ভাবনা আছে। রিয়া বা লোক দেখানোর সুযোগ আছে।

.

২১: আল্লাহ তা‘আলার কাছে সিয়ামের ইবাদত অত্যন্ত প্রিয়। তা না হলে তিনি প্রতিটি উম্মতের উপর সিয়াম ফরয করতেন না।

.

২২: সিয়ামের মাধ্যমে শরীর ও কলব সুস্থ্য হয়। পুষ্ট হয়। প্রবৃত্তির প্ররোচনার কারণে সৃষ্ট কলবের কলুষতা দূর হয়। তাকওয়া অর্জনের পথে সিয়াম অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার।

.

২৩: একটি নিয়ম হল, আমর বা আদেশসূচক ক্রিয়া ও বক্তব্যের পর (لعَلَّ) হরফটি পূর্বের বক্তব্যের কারণ (تَعْلِيْل) বোঝায়।

যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয় (لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ)। তোমরা রোজা রাখলে, তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হবে। তোমরা তাকওয়া অর্জনের জন্য সিয়াম পালন কর। ১৮৬ তম আয়াত সম্পর্কেও একই কথা।

.

২৪: রমাদান হল মাদরাসাতুত তাকওয়া। তাকওয়ার মাদরাসা। সিয়াম বিষয়ক আলোচনার প্রথম আয়াত শেষ হয়েছে (لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ) দিয়ে। ১৮৭-তম আয়াতে সিয়ামের আলোচনা শেষ হয়েছে (لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ) দিয়ে।

.

২৫: সিয়ামের আগাগোড়া পুরোটাই তাকওয়ায় মোড়া। সিয়ামই তাকওয়া অর্জনের অন্যতম বড় মাধ্যম। সিয়ামের মাধ্যমে কলবে তাকওয়ার অবস্থান সুদৃঢ় হয়। রমযানে নিয়মিত নিজের কথাবার্তা, আচার-আচরণের প্রতি গভীর নজর দেয়া উচিত। এসবে তাকওয়ার কোনও প্রভাব ফুটে ওঠে কি না, যাচাই করা উচিত।

.

২৬: রমাদান তাকওয়ার মাস। তাকওয়া অর্জনের প্রধান উপায় গুনাহ ত্যাগ করা। আল্লাহর ভয় (তাকওয়া) আর গুনাহ একসাথ হতে পারে না। তাই রমযান আর গুনাহও এক হওয়ার কথা নয়। শুধু কি তাই, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকাই যথেষ্ট নয়, অতীতের গুনাহর ক্ষমা পাওয়াও জরুরী,

رَغِمَ أنفُ رجلٍ دخلَ علَيهِ رمضانُ ثمَّ انسلخَ قبلَ أن يُغفَرَ لَهُ

রমাদ্বান পেল, ক্ষমা পাওয়ার আগেই মাস কেটে গেল, সে ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত (তিরমিযী ৩৫৪৫)।

.

২৭: রমাদ্বান পাওয়ার পরও, ক্ষমা পাওয়া হয়না কেন? অনেক কারণ থাকতে পারে। আগের মতো গুনাহের উপকরণ থেকে দূরে না থাকাই মূল কারণ। রমাদ্বান শুরু হওয়ার পরও, গাফেল উদাসীন থাক অত্যন্ত ক্ষতিকর। নবীজি সা. বলেছেন,

من لم يدَع قولَ الزُّورِ، والعملَ بِهِ، فلَيسَ للَّهِ حاجةٌ أن يدعَ طعامَهُ وشرابَهُ

যে ব্যক্তি (রমদ্বানে) মিথ্যা কথা ও অন্যায় কাজ ছাড়তে পারল না, তার পানাহার বর্জন করার আল্লাহর কোনও আগ্রহ (প্রয়োজন) নেই (আবু হুরায়রা রা. বুখারি ১৯০৩)।

.

২৮: রমাদ্বানে তাকওয়া লাভের সহজ পদ্ধতি কি? নবীজি সহজ কথায়, সহজ একটি পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন,

إذا كانَ يَوْمُ صَوْمِ أحَدِكُمْ فلا يَرْفُثْ ولا يَصْخَبْ، فإنْ سابَّهُ أحَدٌ أوْ قاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ إنِّي امْرُؤٌ صائِمٌ

তোমরা রোজার দিনে, অশ্লীল কথা বলো না। চেঁচামেচি-ঝগড়া করো না। কেউ গালি দিলে বা লড়াই করতে উদ্যত হলে, বলো, আমি সায়েম। রোজাদার (আবু হুরায়রা রা.। বুখারী ১৯০৪)।

.

২৯: সিয়ামের মাধ্যমে কিভাবে তাকওয়া অর্জিত হয়? সিয়ামের ইবাদতে আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আত্মশক্তি অর্জিত হয়। এই আত্মশক্তিই বান্দাকে গুনাহমুক্ত থাকতে প্রেরণা যোগায়। সিয়ামের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হল, মানুষের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক জুড়ে দেয়।

.

৩০: রমযান আসার আগে, রোজা রাখার হুকুম হয়েছিল। কারণ বলা হয়েছিল ‘তাকওয়া’। তাকওয়া অর্জনের জন্য রোজা রাখতে হবে। আজ রোজা শুরু হয়ে একে একে শেষের দিকে। বান্দা এখন অধীর হয়ে প্রতীক্ষায় আছে, তার সিয়াম-কিয়াম কবুল হবে তো? উত্তরটা আরেক জায়গায় দেয়া আছে, (إِنَّمَا یَتَقَبَّلُ ٱللَّهُ مِنَ ٱلۡمُتَّقِینَ) আল্লাহ তো মুত্তাকীদের পক্ষ হতেই (কুরবানী) কবুল করেন (মায়িদা ২৭)। আমি যতটুকু মুত্তাকী, আমার নামাজ-রোজা ঠিক ততটুকু কবুল হবে।

.

৩১: কেউ কেউ গুরুত্ব দিয়ে সিয়াম পালন করে, সলাত আদায়ে অতটা যত্নবান থাকে না। সিয়াম চতুর্থ রোকন। ইসলামের অন্যতম শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ রোকন সলাত বাদ দিয়ে তাকওয়া কীভাবে অর্জিত হবে?

.

৩২: প্রথমে কথা শুরু হয়েছে (تَحَبُّب) ভালোবাসামাখা সম্বোধন দিয়ে (یَـٰۤأَیُّهَا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟)। শাসন করা তারেই সাজে. সোহাগ করে যে গো। ভালোবাসা দিয়ে দায়িত্ব পালনের (تَأكِيدْ) তাকিদ দিয়েছেন (كُتِبَ عَلَیۡكُمُ ٱلصِّیَامُ)।

.

৩৩: বাঁচতে হলে তাকওয়া অর্জন করতেই হবে। রোযা তাকওয়া অর্জনের শক্তিশালী মাধ্যম। মুত্তাকি নাহলে জান্নাতে প্রবেশ করা যাবে না,

تِلۡكَ ٱلۡجَنَّةُ ٱلَّتِی نُورِثُ مِنۡ عِبَادِنَا مَن كَانَ تَقِیّا

এটাই সেই জান্নাত, যার ওয়ারিশ বানাব আমার বান্দাদের মধ্যে যারা মুত্তাকী তাদেরকে (মারয়াম ৬৩)।

.

৩৪: রোযার মাধ্যমে যদি আমার তাকওয়া অর্জিত না হয়, তাহলে শুধু শরীরের শক্তিক্ষয়ই হবে।

.

৩৫: সূরা বাকারায় শরীয়তের বিধি-বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে (كُتِبَ عَلَیۡكُمُ) এই বাক্যটি এই সূরায় মোট চারবার বর্ণিত হয়েছে।

ক: যাদেরকে (ইচ্ছাকৃত অন্যায়ভাবে) হত্যা করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কিসাস (-এর বিধান) ফরয করা হয়েছে (كُتِبَ عَلَیۡكُمُ ٱلۡقِصَاصُ فِی ٱلۡقَتۡلَىۖ) ১৭৮।

খ: তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে যে, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অর্থ-সম্পদ রেখে যায়, তবে যখন তার মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হবে তখন সে ওসিয়ত করবে (كُتِبَ عَلَیۡكُمُ) ১৮০।

গ: তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে (كُتِبَ عَلَیۡكُمُ ٱلصِّیَامُ)।

ঘ: তোমাদের উপর কিতাল ফরয করা হয়েছে (كُتِبَ عَلَیۡكُمُ ٱلۡقِتَالُ) ২১৬।

.

৩৬: তাকওয়া শুধু রমযানেই বাকি এগারমাসও দরকার। রোজা তাকওয়া অর্জনের প্রধানতম মাধ্যম। প্রতি সপ্তাহে বা মাসে নিয়ম দু’তিনটা করে রোযা রাখা দরকার। তাকওয়ার জন্য। কলবের শুদ্ধির জন্য।

.

৩৭: মাহে রমাদান বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আসে। আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার সুযোগ। আত্মাকে সব ধরনের মলিনতা থেকে মুক্ত করার সুযোগ। তাকওয়ার পথে যাবতীয় বাধাকে ডিঙ্গানোর সুযোগ।

.

৩৮: রমাদানে নেক আমল বেশি করতে না পারলেও, অন্তত বদআমল যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরী।

.

৩৯: রমাদান এলে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করা, নিজের মধ্যে তাকওয়ামুখী প্রবণতা কিছুটা হলেও বেড়েছে তো? আগের তুলনায় নিজের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে না?

.

৪০: তাকওয়া হল ঈমানের বিশেষ অবস্থা, যা বান্দাকে আল্লাহর সাথে জুড়ে রাখে। তাকওয়ার কারণে, তার কলবে সময় এমন এক ধরনের সচেতন বোধ জাগ্রত থাকে। এই বোধ তাকে আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জনে ও আল্লাহর অসন্তুষ্টি বর্জনে সচেষ্ট রাখে।

.

৪১: তাকওয়া চাই? রমাদানের শুরুতেই প্রতিজ্ঞা করে নেবো, আমি গোটামাস কাউকে কষ্ট দেব না। গুনাহের ধারেকাছে ঘেঁষব না। চোখের ছোট্ট একটা দৃষ্টি দিয়েও কাউকে বিরক্ত করব না।

.

৪২: শব্দপ্রয়োগের ক্ষেত্রে কুরআন কারীমের নিজস্ব ধরন আছে। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। সিয়াম (صِيام) ও সাওম (صَوم) দু’টি শব্দ। কুরআন কারীমে প্রথমটি ব্যবহৃত হয়েছে প্রচলিত ‘রোযার’ অর্থে। দ্বিতীয়টি ব্যবহৃত হয়েছে (صَمت) ‘চুপ থাকা’ অর্থে। সামত ও সাওম এই ওযন। অর্থও এক। শুধু ওয়াও এবং ‘তা’-এ পার্থক্য।

إِنِّی نَذَرۡتُ لِلرَّحۡمَـٰنِ صَوۡما فَلَنۡ أُكَلِّمَ ٱلۡیَوۡمَ إِنسِیّا

আমি (মারয়াম) আজ দয়াময় আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি রোজা মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কোনও মানুষের সাথে কথা বলব না (মারয়াম ২৬)।

সাওম (ص و م) শব্দমূলের অর্থ হল বিরত থাকা (إمساك)। রোযা রাখা ও চুপ থাকা উভয় শব্দেই ‘বিরত থাকার’ অর্থ আছে।

.

৪৩: সিয়াম (صِيام) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সুনির্দিষ্ট ইবাদতের জন্য। শব্দটা দেখতে ও পড়তে সাওম (صَوم)-এর তুলনায় লম্বা। সিয়ামের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ও লম্বা। রোজা রাখতে হলে, পানাহার পরিত্যাগ করা থেকে শুরু করে, আরও বহুকিছু লক্ষ্য রাখতে হয়। সময়ও দীর্ঘ, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। সাওম মানে চুপ থাকার জন্য খুব বেশি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখার প্রয়োজন নেই। এজন্য লম্বা ও বিস্তৃত ইবাদতের জন্য ‘সিয়াম’ ব্যবহৃত হয়েছে। সংক্ষিপ্ত বিষয়ের জন্য ‘খাটো’ সাওম ব্যবহৃত হয়েছে।

.

৪৪: তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে। তোমরা ভয় করে চলবে (تَتَّقُونَ)। কী ভয় করবে, কী থেকে বেঁচে থাকবে, সেটা ‘মুতলাক’ বা উন্মুক্ত রেখে দেয়া হয়েছে। বলা হয়নি (اتَّقُوا النارَ) তোমরা আগুন থেকে বেঁচে থাক। অথবা বলা হয়নি (اِتَّقُوْا رَبَّكُم) তোমর রবকে ভয় করো।

.

৪৫: কী থেকে বেঁচে থাকবে, সুনির্দিষ্টভাবে না বলাতে, রোযাদারের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। সব ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকবে। রোযা ক্ষতি হয়, রোযাকে দুর্বল করে দেয়, এমন সব কাজকর্ম থেকে বেঁচে থাকবে। তাকওয়া অর্জনের জন্য যা যা করা দরকার, সবই করতে হবে।

.

৪৬: সূরা বাকারা বিধি-বিধানের সূরার পাশাপাশি, তাকওয়ার সূরাও বটে। তাকওয়া শব্দটির মূল হল ()। এই শব্দমূলটি পুরো বাকারায় সর্বমোট ৩৬ বার ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারায় নানাভাবে তাকওয়ার কথা বলেছেন। তাকওয়ার তাকিদ দিয়েছেন।

.

৪৭: বাকারার সূচনাতে তাকওয়া (هُدى لِّلۡمُتَّقِینَ)। সিয়ামের আলোচনা শুরু হয়েছে তাকওয়ার আবহে। প্রায় সব জায়গাতেই তাকওয়াকে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কোনও কিছুর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়নি।

ক: পুণ্যবানদের তালিকা পেশ করার পর উপসংহার টানা হয়েছে (وَأُو۟لَـٰۤىِٕكَ هُمُ ٱلۡمُتَّقُونَ) এবং এরাই মুত্তাকী (১৭৭)।

খ: কিসাসের আলোচনা করে শেষে বলেছেন (لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ) আশা করা যায় তোমরা (্এর বিরুদ্ধাচরণ) পরিহার করবে (১৭৯)।

গ: ওসিয়তের আলোচনা শেষে বলেছেন (حَقًّا عَلَى ٱلۡمُتَّقِینَ) এটা মুত্তাকীদের অবশ্য কর্তব্য ১৮০।

ঘ: সিয়ামের আলোচনাতে দুইবার তাকওয়ার কথা বলেছেন। একবার (لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ) আরেকবার (لَعَلَّهُمۡ یَتَّقُونَ)।

ঙ: তারপর পবিত্র মাসসমূহের আলোচনা শেষ করে বলেছেন (وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَٱعۡلَمُوۤا۟ أَنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلۡمُتَّقِینَ) আর আল্লাহকে ভয় করে চলো এবং জেনে রেখ, আল্লাহ তাদেররই সঙ্গে থাকেন, যারা (নিজেদের অন্তরে তাঁর) ভয় রাখে ১৯৪।

.

৪৮: তাকওয়া মানে নিজেকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখা। মুত্তাকী মানে, যে নিজেকে গুনাহের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কারো কারো মতে, আল্লাহ যেখানে যেতে বা যা করতে নিষেধ করেছেন, সেখানে না যাওয়া বা সেটা না করা। আল্লাহ আমাকে যেখানে যেতে বা যেখানে থাকতে আদেশ করেছেন, সেখানে আমি অনুপস্থিত না থাকা।

.

৪৯: আল্লাহ তা‘আলা (یَـٰۤأَیُّهَا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟) ‘হে মুমিনগণ’ বলে, নিজেই সরাসরি বান্দাকে সম্বোধন করেছেন। নবীর মাধ্যমে বলাননি (قُلْ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟) হে নবী, আপনি বলে দিন, হে মুমিনগণ’! রোযা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। বান্দাকে সরাসরি সম্বোধন করে গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। পাশাপাশি বান্দার গুরুত্বও বোঝানো হয়েছে।

.

৫০: কুরআন কারীমে কাতাবা (كَتَب) ক্রিয়াটির ব্যবহার নিয়ে কয়েকটি বিষয় জানা থাকলে আয়াতসমূহের মাফহুম (অন্তর্নিহিত অর্থ) বুঝতে সহজ হবে,

ক: লাম (ل) সহযোগে। বান্দার অনুকূল বা উপকারী কিছু বোঝাবে।

খ: আলা (على) সহযোগে। বান্দার উপর আবশ্যক বা ফরয (أَلْزَمَ وجب فرَضَ) কিছু বোঝায়।

গ: কাতাবা (كَتَب) ক্রিয়াটি (مَعرُوف) কর্তৃবাচ্য হবে। ‘কাতাবা’ ক্রিয়া ব্যবহার করে, আল্লাহ তা‘আলা বান্দার অনুকূল কল্যাণকর ও পছন্দনীয় বিষয় প্রকাশ করেন,

وَٱبۡتَغُوا۟ مَا كَتَبَ ٱللَّهُ لَكُمۡۚ

এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা-কিছু লিখে রেখেছেন তা সন্ধান করর (বাকারা ১৮৭)।

২: আরেকটি আয়াত দেখি,

كَتَبَ عَلَىٰ نَفۡسِهِ ٱلرَّحۡمَةَۚ

তিনি রহমতকে নিজের প্রতি অবশ্য কর্তব্যরূপে স্থির করে নিয়েছেন (আন‘আম ১২)।

৩: কিন্তু আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের ভালোবাসা সঞ্চার করেছেন এবং তাকে তোমাদের অন্তরে করে দিয়েছেন আকর্ষণীয় (হুজুরাত ৭),

وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ حَبَّبَ إِلَیۡكُمُ ٱلۡإِیمَـٰنَ وَزَیَّنَهُۥ فِی قُلُوبِكُمۡ

৪: আর আমার রহমত, সে তো প্রত্যেক বস্তুতে ব্যাপ্ত। সুতরাং আমি এ রহমত (পরিপূর্ণভাবে) সেই সব লোকের জন্য লিখব, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় এবং যারা আমার আয়াতসমূহে ঈমান রাখে (আ‘রাফ ১৫৬)।

وَرَحۡمَتِی وَسِعَتۡ كُلَّ شَیۡءࣲۚ فَسَأَكۡتُبُهَا لِلَّذِینَ یَتَّقُونَ وَیُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱلَّذِینَ هُم بِـَٔایَـٰتِنَا یُؤۡمِنُونَ

ঘ: কুতিবা (كُتِب) ক্রিয়াটি (مَجهول) কর্মবাচ্য হলে, বান্দার অপছন্দনীয়, কষ্টকর ও কঠিন বিষয় প্রকাশ করা হয়। এ-ধরনের কাজকে আল্লাহ সরাসরি নিজের দিকে সম্পৃক্ত করে প্রকাশ করেন না,

১: তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে,

كُتِبَ عَلَیۡكُمُ ٱلصِّیَامُ

২: তোমাদের উপর কিতাল ফরয করা হয়েছে, আর তা তোমাদের কাছে অপ্রিয় (বাকারা ২১৬),

كُتِبَ عَلَیۡكُمُ ٱلۡقِتَالُ وَهُوَ كُرۡه لَّكُمۡۖ

৩: তোমাদের উপর কিসাস ফরয করা হয়েছে (বাকারা ১৭৮),

كُتِبَ عَلَیۡكُمُ ٱلۡقِصَاصُ

ঙ: মানুষের জন্য ওই সকল বস্তুর আসক্তিকে মনোরম করা হয়েছে, যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক (আলে ইমরান ১৪),

زُیِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ ٱلشَّهَوَ ٰ⁠تِ

চ: আরও লক্ষ্যণীয় বিষয়, প্রশংসামূলক স্থানে আল্লাহ বলেছেন (ءَاتَیۡنَـٰهُمُ ٱلۡكِتَـٰبَ) আমি তাদেরকে কিতাব দিয়েছি। নিন্দামূলক স্থানে বলেছেন (أُوتُوا۟ ٱلۡكِتَـٰبَ) তাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে।

.

৫১: একটি আয়াত নিয়ে প্রশ্ন উদ্রেক হতে পারে, এখানে ফেয়েলে মারূফ ব্যবহৃত হল যে?

وَكَتَبۡنَا عَلَیۡهِمۡ فِیهَاۤ أَنَّ ٱلنَّفۡسَ بِٱلنَّفۡسِ وَٱلۡعَیۡنَ بِٱلۡعَیۡنِ

এবং আমি তাতে (তাওরাতে) তাদের (বনী ইসরায়েলের) জন্য বিধান লিখে দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ (মায়িদা ৪৫)।

নবী ইসরায়েল নিজেরাই বিধানকে কঠিন করে তুলেছিল। ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তা‘আলাও কঠিন করে দিয়েছেন। তাদের চাহিদা ও অবস্থা অনুসারেই বিধান দিয়েছেন। তাই সরাসরি ‘ফেয়েলে মারূফ’ বা কর্তৃবাচ্য ব্যবহার করেছেন।

.

৫২: সিয়ামের মূল নির্যাস যদি ‘তাকওয়া’ হয়, তাহলে সিয়ামের মূল ভিত্তি হল ‘সবর’। আগে ও পরের আয়াতগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সিয়ামের আলোচনা মোটাদাগে দু’টি বিষয়ের আবহে গড়ে উঠেছে,

ক: তাকওয়া।

খ: সবর।

.

৫৩: হাদীসে আছে (الصَّومُ نِصفُ الصَّبْر) সওম সবরের অর্ধেক (তিরমিযী ৩৫১৯)। আরেক হাদীসে আছে (الصبر نصف الإيمان) সবর ঈমানের অর্ধেক (ইবনে মাসউদ রা. হাকেম ৩৬৬৬)।

.

৫৪: সবর, সওম ও ঈমান তিনটি একসূত্রে গাঁথা,

ক: পুণ্য ও পুণ্যবানদের আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে (وَٱلصَّـٰبِرِینَ فِی ٱلۡبَأۡسَاۤءِ وَٱلضَّرَّاۤءِ وَحِینَ ٱلۡبَأۡسِۗ) এবং সঙ্কটে, কষ্টে ও যুদ্ধকালে ধৈর্যধারণ করে (বাকারা ১৭৭)।

খ: ১৭৮-তম আয়াতে কিসাসের আলোচনা করা হয়েছে। কিসাস বাস্তবায়নে সবরের প্রয়োজন হয়।

গ: ১৮০-তম আয়াতে মৃত্যুপথযাত্রীকে ওসিয়তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই বিধানও সবরের দাবি রাখে।

ঘ: ১৯০-তম আয়াতে কিতালের কথা বলা হয়েছে (وَقَـٰتِلُوا۟ فِی سَبِیلِ ٱللَّهِ ٱلَّذِینَ یُقَـٰتِلُونَكُمۡ) যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ কর।

ঙ: ১৯১-তম আয়াতে বলা হয়েছে (وَٱقۡتُلُوهُمۡ حَیۡثُ ثَقِفۡتُمُوهُمۡ) তোমরা তাদেরকে যেখানে পাও হত্যা কর।

চ: ১৯৩-তম আয়াতে বলা হয়েছে (وَقَـٰتِلُوهُمۡ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتۡنَة) তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাক, যতক্ষণ না ফিতনা খতম হয়ে যায়।

জ: ১৯৭-তম আয়াতে বলা হয়েছে (الحَجَّ أشهُرٌ معلوماتٌ) হজ্জের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস আছে।

ঝ: অসুস্থ হলে, হাজী ও রোযাদার উভয়ের জন্য ফিদইয়ার বিধান দেয়া হয়েছে।

.

৫৫: হজ-কিতাল-সিয়াম, প্রতিটি ইবাদতই সবরের উপর নির্ভরশীল। তিনটির আলোচনাও পাশাপাশি করা হয়েছে।

.

.

.

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ শত্রুতা! □□

-

✍ আহলে কিতাব (ইহুদী-নাসারা) কি আমাদের বন্ধু হতে পারে? কখনোই না। বিশেষ করে ইহুদীরা। তারা কস্মিনকালেও আমাদের আপন হতে পারে না। তারা শুধু আমাদেরই নয়, কারোরই বন্ধু হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীমের অসংখ্য আয়াতে এ-বিষয়ে বলেছেন। যারা দাওয়াতের জন্য বা সুন্দর সহাবস্থানের জন্য ইহুদীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর পক্ষপাতি, তারা বোকার স্বর্গে বাস করে। দুয়েকজন ইহুদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা নিজের স্বপক্ষে যুক্তি হতে পারে না। কুরআনের কথাই স্বতসিদ্ধ,

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يَشْتَرُونَ الضَّلَالَةَ وَيُرِيدُونَ أَنْ تَضِلُّوا السَّبِيلَ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِأَعْدَائِكُمْ ۚ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ وَلِيًّا وَكَفَىٰ بِاللَّهِ نَصِيرًا

۩ যাদেরকে কিতাবের অংশ (অর্থাৎ তাওরাতের জ্ঞান) দেওয়া হয়েছিল, আপনি কি দেখেননি, তারা কীভাবে পথভ্রষ্টতা ক্রয় করছে? এবং তারা চায়, তোমরাও যেন পথভ্রষ্ট হয়ে যাও। আল্লাহ তোমাদের শত্রুদেরকে ভালো করেই জানেন। অভিভাবকরূপেও আল্লাহ যথেষ্ট এবং সাহায্যকারী হিশেবেও আল্লাহই যথেষ্ট (নিসা ৪৪-৪৫)।

☝ ইহুদিদের দু’টি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে,

➨ ১: তারা কীভাবে পথভ্রষ্টতা ক্রয় করছে (يَشْتَرُونَ الضَّلَالَةَ)?

➨ ২: এবং তারা চায়, তোমরাও যেন পথভ্রষ্ট হয়ে যাও (وَيُرِيدُونَ أَنْ تَضِلُّوا السَّبِيلَ)।

✍ মনে হতে পারে, এখানে শত্রুতা কোথায়? সব কাফেরই পথভ্রষ্ট। ভ্রষ্টতা নিয়েই তারা সন্তুষ্ট। তারা মনে মনে চায়, আমরাও তাদের মতো হয়ে যাই। তাদের এই গোপন চাওয়ায় আমাদের কোনও ক্ষতি হওয়ার আশংকা নেই। জি¦, সরল মুমিন কাফেরের বাহ্যিক মধুমুখ দেখে ধোঁকা খেয়ে যেতে পারে। তাই আল্লাহ তা‘আলা সরাসরি বলে দিয়েছেন,

আল্লাহ তোমাদের শত্রুদেরকে ভালো করেই জানেন (وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِأَعْدَائِكُمْ ۚ)। আমরা মানুষের বাহ্যিক রূপ দেখি। আল্লাহর তাদের ভেতরের রূপ দেখেন। ইহুদিরা অন্তরে অন্তরে মুমিনের প্রতি কী ঘৃণা আর বিদ্বেষ লুকিয়ে রাখে, সেটা আল্লাহ ভালো জানেন,

وَإِنَّ رَبَّكَ لَیَعۡلَمُ مَا تُكِنُّ صُدُورُهُمۡ وَمَا یُعۡلِنُونَ

☝ এবং নিশ্চয়ই আপনার প্রতিপালক তাদের অন্তর যা-কিছু গোপন রাখে তাও জানেন এবং তারা যা-কিছু প্রকাশ করে তাও (নামল ৭৪)।

✍ তারা আমাদেরকে গোমরাহ করতে চায়। এই চাওয়াকেই আল্লাহ শত্রুতা আখ্যা দিয়েছেন। তারা শত্রু হওয়ার জন্য, মনে মনে আমাদেরকে গোমরাহ করতে চাওয়াই যথেষ্ট। তারা আমাদের প্রতি কখনোই সন্তুষ্ট হবে না,

وَلَن تَرۡضَىٰ عَنكَ ٱلۡیَهُودُ وَلَا ٱلنَّصَـٰرَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمۡۗ

۩ ইয়াহুদী ও নাসারা আপনার প্রতি কিছুতেই খুশি হবে না, যতক্ষণ না আপনি তাদের ধর্মের অনুসরণ করেন (বাকারা ১২০)।

✍ তাদের এই গোপন শত্রুতা থেকে আমরা কীভাবে রক্ষা পাব? আল্লাহ শত্রুদের ব্যাপারে সতর্ক করার পাশাপাশি অভয়ও দিয়েছেন,

➨ ক: অভিভাবকরূপেও আল্লাহ যথেষ্ট (وَكَفَىٰ بِاللَّهِ وَلِيًّا)। আল্লাহ আমাদের ওলী বা অভিভাবক। তিনি আমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসেন। ইহুদিদের শত্রুতায় আমাদের কোনও ভয় নেই।

ٱللَّهُ وَلِیُّ ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ یُخۡرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِۖ

۩ আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার বের করে আলোতে নিয়ে আসেন (বাকারা ২৫৭)।

➨ খ: এবং সাহায্যকারী হিশেবেও আল্লাহই যথেষ্ট (وَكَفَىٰ بِاللَّهِ نَصِيرًا)। ইহুদী-নাসারার প্রকাশ্য শত্রুতা তো বটেই, গোপন শত্রুতার ক্ষতির ব্যাপারেও আল্লাহ আমাদেরকে সাহায্য করবেন। কাফেরদের বাহ্যিক বিদ্বেষের চেয়ে গোপন বিদ্বেষ আরও ভয়ংকর,

یَـٰۤأَیُّهَا ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ لَا تَتَّخِذُوا۟ بِطَانَة مِّن دُونِكُمۡ لَا یَأۡلُونَكُمۡ خَبَالا وَدُّوا۟ مَا عَنِتُّمۡ قَدۡ بَدَتِ ٱلۡبَغۡضَاۤءُ مِنۡ أَفۡوَ ٰ⁠هِهِمۡ وَمَا تُخۡفِی صُدُورُهُمۡ أَكۡبَرُۚ

۩ হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের বাইরের কোনও ব্যক্তিকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানিয়ো না। তারা তোমাদের অনিষ্ট কামনায় কোনও রকম ত্রুটি করে না। যাতে তোমরা কষ্ট পাও তাই তারা কামনা করে। তাদের মুখ থেকেই আক্রোশ বের হয়ে গেছে। আর তাদের অন্তরে যা-কিছু (বিদ্বেষ) গোপন আছে, তা আরও গুরুতর (আলে ইমরান ১১৮)।

✍ এতটা স্পষ্ট করে বলে দেয়ার পরও, যারা ইহুদী-নাসারাদের সাথে বন্ধুত্ব ও সুখময় সহাবস্থানের প্রবক্তা, তাদের মনে সন্দেহের লেশমাত্র থাকার কথা? আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেই দিয়েছেন,

قَدۡ بَیَّنَّا لَكُمُ ٱلۡـَٔایَـٰتِۖ إِن كُنتُمۡ تَعۡقِلُونَ

۩ আমি আসল বৃত্তান্ত তোমাদের কাছে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিলাম। যদি তোমরা বুদ্ধিকে কাজে লাগাও।

✍ এভাবে বলার পরও যারা কুফরের সাথে বন্ধত্বে বিশ্বাসী, তাদের বুদ্ধি-বিবেচনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে।

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□

□□ ☂ ঈমান! □□

-

✍ ঈদের ব্যস্ততায় কয়েকদিন নিয়মিত ‘হিযব’ আদায় করা হয়ে ওঠেনি। আমাদের মাদরাসার নিয়ম হল, আরবী তারিখ মিলিয়ে একপারা তিলাওয়াত করা। ছুটিতে বাড়িতে থাকলেও এই রুটিন পালন করতে হয়। এখন মাদরাসায় এসে কাযা হয়ে যাওয়া ‘হিযব’ আদায় করা শুরু হল।

✍ আল্লাহর তা‘আলার খাস রহমতে, কুরআন কারীম তিলাওয়াত করতে বসলে, প্রতিটি আয়াত তিলাওয়াতের সময়ই মাথায় নানা চিন্তা, নানা কথা (তাদাব্বুর?) এসে জড়ো হয়। প্রতিবারের খতমেই এই আয়াতে এসে থমকে দাঁড়াই,

وَإِذَا قِیلَ لَهُمۡ ءَامِنُوا۟ كَمَاۤ ءَامَنَ ٱلنَّاسُ قَالُوۤا۟ أَنُؤۡمِنُ كَمَاۤ ءَامَنَ ٱلسُّفَهَاۤءُۗ أَلَاۤ إِنَّهُمۡ هُمُ ٱلسُّفَهَاۤءُ وَلَـٰكِن لَّا یَعۡلَمُونَ

۞ যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরাও সেই রকম ঈমান আন, যেমন অন্য লোকেরা ঈমান এনেছে। তখন তারা বলে, আমরাও কি সেই রকম ঈমান আনব, যে রকম ঈমান এনেছে নির্বোধ লোকেরা? জেনে রেখ, এরাই নির্বোধ, কিন্তু তারা তা জানে না (বাকারা ১৩)।

.

✍ এক বিস্ময়কর আয়াত!

এই আয়াত অতিক্রম করার সময় প্রতিবারই মুলহিদ (নাস্তিক)-দের কথা মনে পড়ে। মুলহিদরা কথায় কথায় ‘মুমিনগনকে’ কটাক্ষা করে। তাদেরকে নির্বোধ মনে করে। মুমিনরা নিজের মেধা-বুদ্ধি কাজে লাগায় না। মুমিনগন জড়মস্তিস্ক আর স্থূলবুদ্ধির লোক।

অথচ মুলহিদদের চিন্তাই স্থবির। সৃষ্টিকর্তার প্রতি আত্মনিবেদিত হওয়া, মানুষের স্বভাবজাত প্রবণতা। হোক মূর্তি বা দেবদেবী, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সবসময় কোনও-না-কোনও বৃহৎ সত্ত্বার প্রতি আত্মসমর্পিত ছিল। ভুলভাবে হলেও প্রতিটি সভ্যতা নিজের মতো করে এক বা একাধিক সৃষ্টিকর্তায় বিশ^াসী ছিল। মানবসৃষ্টির মৌলিক উপাদানের মধ্যেই ¯্রষ্টার প্রতি অনুগত হওয়ার ‘বীজ’ রোপিত আছে। কোনও সভ্যতাই উপাস্যবিহীন ছিল না। এমনকি আধুনিকমনাদের আদর্শ ‘গ্রীকসভ্যতা’-ও নানা দেব-দেবীতে বিশ^াসী ছিল। যারা আল্লাহর প্রতি বিশ^াস রাখে না, তারাই প্রকৃত নির্বোধ।

✍ আয়াতের প্রথমাংশে আমাদেরকে সাহাবায়ে কেরামের মতো ঈমান আনতে বলা হয়েছে। আমি কি সত্যি সত্যি সাহাবায়ে কেরামের ঈমান আনতে পেরেছি? কখনো ভেবে দেখেছি এ-বিষয়ে? কখনো তাদের ঈমানের সাথে নিজের ঈমান তুলনা করে দেখেছি?

.

আত্মসমীক্ষা!

✑ ১: আমি কি আয়াতটার মূলবার্তা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছি? তরজমা-তাফসীর পড়ে, আয়াতটি সম্পর্কে দু’চার কথা বলতে বা লিখতে পারব?

✑ ২: কুরআনের প্রতিটি আয়াতই আমার জন্য অসংখ্য শিক্ষা বহন করে। আমি এই আয়াত থেকে যা শিখতে পারলাম, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা কী?

✑ ৩: আমি কি সত্যি সত্যি এতদিন এই আয়াতের শিক্ষার অনুসারী ছিলাম? এই আয়াতের শিক্ষার প্রেক্ষিতে এতদিন আমার অবস্থান কোথায় ছিল?

✑ ৪: এই আয়াতকে সামনে রেখে, গভীরভাবে চিন্তা করে আত্মসমালোচনা করতে পারি। আয়াতের শিক্ষার আলোকে আমার মধ্যে কী কী ঘাটতি আর খামতি আছে।

✑ ৫: আমি যদি এই আয়াতের শিক্ষানুসারে আমল করি, তাহলে আমার মধ্যে কী কী ইতিবাচক দিক আসবে? আমি কী কী সুফল ভোগ করব? আমার কী উপকার হবে?

✑ ৬: আয়াত অনুযায়ী আমল করার সুফলগুলো মনের চোখে কল্পনা করে, নিজেকে সুফলভোগী অবস্থায় কল্পনা করে দেখেছি? একবার কি যাচাই করে দেখব, আয়াতের আমলকারী হিশেবে আমার জীবনটা কেমন কাটবে?

✑ ৭: আমি যদি এই আয়াত অনুযায়ী আমল না করি, তাহলে আমার কী কী ক্ষতি হবে?

✑ ৮: একবার কল্পনা করে দেখতে পারি কি, এই আয়াতের উপর আমলবিহীন জীবন কতটা ক্ষতিগ্রস্ত, অসুখী আর অন্ধকারময়?

✑ ৯: আমি এই আয়াত তিলাওয়াত করার পর আমার প্রথম অনুভূতি কী ছিল?

✑ ১০: আল্লাহর তাওফীক ছাড়া কোনও কিছুই সম্ভব নয়। এই আয়াতের শিক্ষার উপর আমল করতে চাইলে, কোন দু‘আটা আমার জন্য সহায়ক হবে?

✑ ১১: এই আয়াত তিলাওয়াত করার পর, আমাকে কোন কোনও গুণ অর্জন করতে হবে আর কোন কোন দোষ ছাড়তে হবে, সেটা কি আমার কাছে পরিস্কার?

✑ ১২: আমি কিভাবে সেসব গুণ অর্জন করতে পারব, আর সেসব দোষ বর্জন করতে পারব? কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে ভেবেছি কি?

✑ ১৩: এই আয়াতের প্রেক্ষিতে, আমার চিন্তা-চেতনার কোন কোনও দিকটাতে বিবর্তন প্রয়োজন? এবং কীভাবে বিবর্তনপ্রক্রিয়াটা সম্ভবপর হয়ে উঠবে?

✑ ১৪: আয়াতটা মুখস্থ করে নিতে পারি। বেশি বেশি তিলাওয়াত করতে পারি। অন্যের কাছ থেকে শুনতে পারি। অন্যকে শোনাতে পারি।

✑ ১৫: বেশি বেশি রাব্বে কারীমের তাসবীহ পাঠ ও ইস্তেগফারের পাশাপাশি, সলাতে আয়াতটা বেশি বেশি তিলাওয়াত করতে পারি।

✑ ১৬: আয়াত নিয়ে নিজের ভাবনাটা নিজের একান্তজনদের মধ্যে কাকে সর্বপ্রথম জানাব বলে মনে মনে ঠিক করেছি?

.

.

চাইলেই হাতের নাগালে কত কত তাফসীর!

হিম্মত করে একটু খুলে বসলেই হয়!

□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□■■■■■■■■□