ফ্রান্সের উপনিবেশ কোন কোন দেশে ছিল? ফ্রান্স কিভাবে এই গুলো পরিচালনা করত? বর্তমানে ফ্রান্স তাদের সাথে কি রকম আচরণ করে?
পলাশীর যুদ্ধে ফরাসিরা নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সাহায্য করার কারণে ফরাসীদের প্রতি কিছুটা দুর্বলতা ছিল। ভাবতাম ব্রিটিশদের পরিবর্তে ফরাসিদের উপনিবেশ হলে হয়তো আমাদের অবস্থা আরো ভালো হত! কিন্তু পরবর্তীতে যখন তাদের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন সম্পর্কে জানলাম তখন বুঝতে পারলাম যে এরা শুধু মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ (তবে হয়তো ফ্রান্স ব্রিটেনের চেয়েও জঘন্য)।
বর্তমানে যেমন বিভিন্ন দেশে পশ্চিমা গণতন্ত্র রপ্তানির জন্য আক্রমণ চালানো হয়, তেমনি ১৬শ থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পশ্চিমারা বাকি দুনিয়াকে 'সভ্যতার' সবক দেয়ার ঠিকাদারি নিয়েছিল। ফ্রান্স সেই সভ্যতার সবক অন্য পাঁচ মহাদেশেই বড় 'দায়িত্ববোধের' সাথে পৌছে দিয়েছে।
১৬শ শতাব্দী থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অনেক দেশেই ফরাসিরা উপনিবেশ স্থাপন করেছে। বর্তমানেও ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডের বাইরে অনেক যায়গায় ফ্রান্স তাদের দখল বজায় রেখেছে (আমার ঠিক জানা নেই যে সেসব জায়গার জনগণের ইচ্ছাতেই এরকম করা হয়েছে কিনা)। ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া ও ফ্রেঞ্চ গায়ানা তার মধ্যে অন্যতম।
১ম ধাপঃ
ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপন মূলত শুরু হয় নব আবিষ্কৃত আমেরিকা দখলের মাধ্যমে। তারা ১৫৩৪ সালে প্রথম সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে এবং ১৭৬৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন যুদ্ধে হেরে সব এলাকা ব্রিটেন ও স্পেনের কাছে হস্তান্তর করে। তাদের উপনিবেশ মূলত বর্তমান উত্তর আমেরিকা ও ক্যারিবিয় অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল।
উৎসঃ I, JF Lepage, CC BY-SA 3.0 <Creative Commons - Attribution-ShareAlike 3.0 Unported - CC BY-SA 3.0>, via Wikimedia Commons
উত্তর আমেরিকার এই মানচিত্রের নীল অঞ্চলগুলো ১৭৫০ সালে ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর যে অঞ্চলগুলোতে নীল এবং লাল বার দেয়া সেগুলো ১৭১৩ সালের এক চুক্তি অনুসারে ফ্রান্স ব্রিটেনের কাছে হস্তান্তর করে।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ও অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ফরাসিরা সেনেগাল, ভারত মহাসাগরের কিছু দ্বীপদেশ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু ছোট অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপনে সমর্থ হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চন্দননগর ও পণ্ডিচেরি।
২য় ধাপঃ
ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৮৩০ সালে আলজেরিয়া আক্রমণের মাধ্যমে। পরবর্তীতে তারা পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার বিশাল এলাকায় সাম্রাজ্য স্থাপনে সক্ষম হয়। এছাড়াও মাদাগাস্কার সহ আরো কিছু দ্বীপ দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে।
উৎসঃ DW
এই মানচিত্রে বর্তমান সীমানা অনুসারে আফ্রিকার বিভিন্ন উপনিবেশ দেখানো হয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ৩য় নেপোলিয়নের শাসনামলে তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লাওস ও কম্বোডিয়া এবং পরবর্তীতে ভিয়েতনামে উপনিবেশ স্থাপন করে। এই সম্রাটের শাসনামলেই তারা স্বল্পসময়ের জন্য মিশর দখলেও সমর্থ হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ফ্রান্সের উপনিবেশ। উৎসঃ National Museum of the United States Air Force.
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপদেশঃ
ফরাসিরা ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত অনেকগুলো দ্বীপ দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে। বর্তমানে যে ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া নামক অঞ্চলটি ফ্রান্সের অধীনে আছে সেটিও এই সময়েই দখল করেছিল।
এছাড়াও ১ম বিশ্বযুদ্ধের পরে বিজয়ী মিত্রবাহিনীর অংশ হিসেবে ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল এলাকা নিজেদের দখলে নিয়েছিল।
ফরাসিরা তাদের উপনিবেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে, আরো বেশি সংখ্যক মানুষকে দাস হিসেবে বিক্রি করেছে। তাদের উপনিবেশন স্থাপন তারা জাস্টিফাই করত সভ্যতার সবক দেয়ার বুলি দিয়ে। সেই সভ্যতার প্রসার করতে যেয়ে তারা স্থানীয় মানুষের উপর বর্বরতম নির্যাতন চালিয়েছে। স্থানীয় মানুষের সংস্কৃতিকে পুরোপুরি ধ্বংসের জন্য বিভিন্ন নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছে। তাদের কার্যক্রম কোনোক্রমেই জেনোসাইডের চেয়ে কম ছিল না।
ঔপনিবেশিক আমলে ফ্রান্স যে পরিমাণ শোষণ করেছে তা অবর্ণনীয়। তাদের শোষণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল মালি। ফরাসিদের দখলের আগে মালি ছিল খুবই সমৃদ্ধ এবং ধনী এক দেশ। আর বর্তমানে মালি পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি।
বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ হল হাইতি। এর অন্যতম প্রধান কারণ হল ফ্রান্সকে পরিশোধ করা হাইতির বিশাল অংকের ঋণ। হাইতি ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল অনেক আগে (১৮০৪ সালে)। পরে ১৮২৫ সালে ফ্রান্স আবার হাইতিকে আক্রমণ করে। যদিও ফ্রান্স যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি কিন্তু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের আশায় হাইতি ফ্রান্সকে বিশাল অংকের অর্থ পরিশোধে রাজী হয়। তাদের এই ঋণ পরিশোধ করতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময় লাগে এবং এই অর্থও তারা ধার করে বিভিন্ন পশ্চিমা ব্যাংক থেকে বড় অংকের সুদের বিনিময়ে। ১৯০০ সালে তারা যে পরিমাণ ঋণ শোধ করত তা তাদের জিডিপির ৮০% ছিল। উল্লেখ্য, হাইতি স্বাধীনতা লাভ করেছিল দাসদের নেতৃত্বে দাস বিদ্রোহের মাধ্যমে এবং ফ্রান্স এই অর্থ নিয়েছে হাইতির স্বাধীনতা লাভে তাদের দাস ব্যবসার ক্ষতিপূরণ হিসেবে!
যদিও উপনিবেশগুলো ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছে কিন্তু ফ্রান্স স্বাধীনতা দেয়ার আগে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চেয়েছে যাতে এই দেশগুলো সবসময় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক সবদিক থেকে সবসময় পঙ্গু হয়ে থাকে। এবং তারা আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশে এই অবস্থা কায়েমে সক্ষমও হয়েছে।
ফ্রান্স গণতন্ত্রের 'বাহক' হলেও এই দেশগুলোতে যাতে ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে পুঞ্জীভূত থাকে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, ফলে দেশগুলোতে দুর্নীতি ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে আর ঐ ক্ষমতাধর ব্যক্তিকেও ফ্রান্সের পুতুল বানিয়ে রাখা সহজ হয়েছে। যদি কোনো শাসক দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে চেয়েছেন তো তাকে উৎখাতের জন্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
সন্ত্রাস দমনের নামে নিজেদের স্বার্থ কায়েমে সেনা মোতায়েনও করেছে। এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেছে যেন এই দেশগুলো কখনোই নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে। অর্থনীতি আমি ভালো বুঝি না বলে এখানে ব্যাখ্যা করতে পারলাম না। তবে পশ্চিমা এক সংবাদমাধ্যমের করা এই প্রতিবেদন পড়ে দেখতে পারেন।