মর্গ থেকে বলছি (Horror Story)
মর্গ থেকে বলছি
এস, এম, রাহাত পারভেজ রুদ্র
পর্ব ১
রাতে খুব একটা ঘুম হয়নি। বাড়ি থেকে ফিরেছি রাতের বাসে। উদাস দিগন্ত যখন রাতের নিস্তব্ধতায় ডুবে যায় ওই মহুর্তটা আমাকে বেশ টানে। জানালার পর্দা সরিয়ে তাকিয়ে ছিলাম দূর দূরান্তে। সকালে বাসায় ফিরে নিজস্ব কিছু কাজ সেরে বিকেল নাগাদ ঘরে ফিরেছি। বাবা আর আমার মেয়ে আয়াতের জন্য মন খারাপ সাথে জাগতিক সব কিছুর উপর তিক্ততা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙ্গে রাত ৮ টায় শারমিন ম্যামের কলে।
- আসসালামু আলাইকুম
- ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কোথায় তুমি রুদ্র?
- ম্যাম আমি বাসায়। সকালে এসেছি।
- তুমি কী অসুস্থ?
- না ম্যাম ঘুম ছিলাম। কিছুটা ক্লান্ত।
- বাবা রাতে মাসুমের ডিউটি ছিল। তার বউ অসুস্থ। ২ টা বডি আছে। তুমি একটু আজ রাতটা দেখো। রাশেদ ও থাকবে।
- ম্যাম রাশেদ ভাই থাকলে আমি আর কেন। উনি....
- দেখো আমি বাহানা শুনতে চাইনা। তুমি থাকছো এটাই ফাইনাল। আমি কাল আসবো না। রিপোর্ট রেডি করার আগে আমাকে ফোনে জানিও। নিজে শিখে নাও। ফাঁকিবাজি করো কেন সব সময়।
- আচ্ছা ম্যাম। আমি ৯ টায় চলে যাবো।
- ঠিক আছে। রাখলাম
- আসসালামু আলাইকুম।
উঠে ফ্রেশ হয়ে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট টা কতোটা বাস্তববাদিতায় বিশ্বাসী। একটা মানুষের জীবন, মৃত্যু আর মৃত্যুর কারণ পুরোপুরিভাবে জানা যায় কয়েক মহুর্তের মধ্যেই। আবার ভুলেও যাই নতুন লাশ, নতুন গল্পের ভীড়ে।
ভাবতে ভাবতেই দেখি ফোন ভাইব্রেট করছে। নীলাদ্রীর ফোন। স্ক্রিনে থাকা তার ছবিটি আমার সারাদিনের বিষাদ কাটিয়ে দিতে যথেষ্ট। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে এক রাশ ঝাড়ি। আর আমি বরাবরের মতো হো হো করে হাসছিলাম। নীলাদ্রী আমার আয়াতের মা। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি ২৭ টা মিসড কল। যার ১ টা শারমিন ম্যামের। বাকী ২৬ টা আমার মহারাণীর। একবার শুরু হলে তার লেকচার শেষ হয়না। আমি শুধু শুনি আর হাসি। ও আরো রেগে যায়। ওকে রাগিয়ে কেমন যেন পৈশাচিক আনন্দ পাই আমি। আমি সব শুনে আস্তে করে বললাম
-চুপ চুপ একটু শুনো। তোমার ভয়েস আজ এমন কেন?
- কেমন?
- প্রথম দিকটার মতো মনে হচ্ছে আজ। যে কন্ঠের মাদকতায় আমি আমার অবিবাহিত জীবনের অনেকগুলো রাত গচ্ছানো গেছে।
- এইইইই! কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবেনা একদম।
- ঘুরাচ্ছিনা! আয়াত কে জিজ্ঞেস করো ওর কী ভাইবোন লাগবেনা?
- নাহ লাগবেনা।
- আরেহ মেয়ে হাটতে শেখার পর থেকে আমাকে আর তোমাকে ভাইবোন বানিয়ে রেখে দিয়েছে।
- তোমার মুখে কিছু আটকায় না। বাসা থেকে বের হয়েছো গতকাল রাতে। আজ এ অব্দি তোমার কোন খবর ছিল? আব্বু বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন তুমি পৌঁছেছো কী না।
- আরেহ রাতে আমি প্রকৃতিকে জানান দিচ্ছিলাম পূর্নীমার আলো আর রাতের আঁধার মিশ্রিত হয়ে পৃথিবীর বুকে প্রতিফলিত হওয়ার সৌন্দর্য আমার প্রিয়তমা নীলাদ্রীর হাসির সৌন্দর্যের কাছে ফিকে হয়ে যাবে।
" রাত্ গভীর হলে একা একা হাঁটি
হেঁটে হেঁটে আমি বহু পথে ঘুরি
আমি সেই সব পথের শেষ খুঁজে ফিরি-
তুমি সুন্দর, তুমি সুন্দরী!"
- চুউউউপ ঠারকি। আব্বুকে ফোন দিচ্ছি কথা বলো।
- আচ্ছা দাও, আয়াত কই?
- ঘুম। বিকেল থেকে কাঁদছিল। আপনি তো ঘর থেকে বের হলে ভুলেই যান আমরাও আছি আপনার জীবনে।
- ভালোবাসি... হা হা হা
- হয়েছে! আব্বু নিন।
আমার বাবার হাতে ফোন যেতেই আমার বাচ্চামো আরো বেড়ে গেলো। আমার বাবা যেন আমার ভুপৃষ্ঠ স্বর্গ।
-- এই ব্যাটা! সারাদিন কই ছিলি, কোন খবর নেই।
- আব্বু আমার খারাপ লাগছিল তাই সকাল থেকেই ঘুম।
- আরেহ আবার কী হলো? নিজের যত্ন নিস।
- না আব্বু জার্নির জন্য একটু টায়ার্ড। আপনি ঔষধ খেয়েছেন?
- হ্যাঁ টুনটুনি খাইয়ে দিয়েছে। হা হা হা।
- আচ্ছা আব্বু রেস্ট নিন। আমি বের হবো। আজ রাতে ডিউটি আছে।
- ঠিক আছে বাবা, সাবধানে থাকিস। আল্লাহ হাফেজ
- আসসালামু আলাইকুম।
গোসল সেরে বেরিয়ে পড়লাম। বারবার মাথায় ঘুরছিল আমার মেয়ের কথা। আয়াত আমার সামনে স্লিপ করে পড়ে গেছিলো। আর এরপর থেকে বলে বেড়াচ্ছিল - পাপা মাচ্ছে! পাপা মাচ্ছে।
গিয়ে ঢুকলাম মোড়ের রেস্তোরাঁয়। আমার অর্ডার দেয়া লাগেনা। আলামিন জানে আমি কি খাই। সে নিজ দ্বায়িত্বে যা খাওয়ায় আমি চুপচাপ খেয়ে নিই। আজ ও ব্যাতিক্রম হয়নি। খেয়ে বিল মিটিয়ে রিক্সায় উঠলাম। প্রায় সাড়ে নটা বেজে গেলো। রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে গেলাম। দেখি রমজান আলী দাঁড়ানো।
আসসালামালেকুম স্যার। হবাই আইলেন?
- হুম
- মেডম আমারে কইয়া গেচে আফনে আইবেন।
- কেবিনে কে আছে?
- রাশেদ স্যার আচে।
- বডি নিয়ে আসছে?
- হ স্যার! কাইত কইরে ফালায়া রাকচি। বেয়ান বেলা এই দুইডা আফনে গুছায়া দিয়া তারফর যাইবেন। আমি অহন ঘুমাইতে যাই।
- আপনি চলে গেলে ওখানে ডিউটি কে করবে?
- আরেহ স্যার! রতন আচে, মাজেদ আচে।
- আচ্ছা ঠিক আছে। সকালে আর্লি আসবেন। আর মদ খাবেন না কিন্তু। আপনি মদ খেলে মানুষ আর গরুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না।
- এহহহহেহে, স্যার মদ না গিললে আমার আত কাঁফে।
- আচ্ছা আচ্ছা। কমাই খাইয়েন।
- যাই স্যার।
আমি ডান হাত পকেটে গুঁজে বাঁ হাতে ঘড়ি আর রমজান আলীর চলে যাওয়া সমান্তরালে দেখছিলাম। বৃষ্টি হবে বোধ হয়। রাতের গহীনতার সাথে কালো মেঘের মিশ্রণ। নীলাদ্রির কথা বেশ মনে পড়ছিল। ফোন বের করে ওয়ালপেপারে থাকা ছবিটা দেখছিলাম। বাবা ভাইয়ের আদরে আর প্রাচুর্যে বেড়ে উঠা মেয়েটা আমার হাত ধরে বেরিয়ে এসেছে শুধুমাত্র তাকে ভালোবাসি বলেছিলাম বলে। যেদিন আমাদের বিয়ে হয়েছিল সে আমার চুল খামচে ধরে কানে কানে বলেছিল, Maybe there was a lot of better options. But you are the best. অদ্ভুত এই মেয়ে। ডায়েল লিস্টের একদম উপরেই ছিল তার নাম্বার। রিং হচ্ছে।
- কিরে উজবুক!
- খেয়েছো?
- নাহ, এসে খাইয়ে দিবেন বলে অপেক্ষায় আছি।
- আরেহ মজা নিও না।
- Miss you.
- Miss you too. হ্যাঁ খেয়েছি। তুমি খেয়েছো?
- হ্যাঁ খেলাম। কেবিনে আছি।
- তুমি অলোয়েজ আমার খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেও আব্বু আর আয়াতের খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করোনা। কেন?
- কারণ তাদের না খাইয়ে তুমি কখনো খাওনা।
- আসলেও তুমি উজবুক। ভালোবাসি।
- Love you too. Take care. Bye
- Bye.
ফোন কাটতেই খেয়াল করলাম তুমুল বৃষ্টি আর বজ্রপাত। ভাবা যায়, মর্গে এমন একটা রাত। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলাম। রাশেদ ভাইকে কোথাও দেখছিনা। অটোপসি রুমের বাইরে রতন বসা। ফোন দিলাম রাশেদ ভাইকে। তিনি জানালেন বৃষ্টিতে ভাবি ভয় পাচ্ছিলেন, তাই বাসায় চলে গেছেন। আমি যেন সামলে নিই। আবারো তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে কেবিনের সামনে গেলাম। ছিঁটকিনি খোলা দরজা ভেজানো। অল্প ধাক্কাধাক্কি করতেই খুলে গেলো। দরজা খুলতেই ভেতর থেকে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা আর কোন এক ফুলের কড়া ঘ্রাণ নাকে এসে ঠেকলো। একটা লাইট জ্বলছিল, কে যেন বসে আছে রুমে। বাকী দুটো লাইট জ্বালালাম। দেখি গেস্ট চেয়ারে একটা মেয়ে বসে। গিয়ে চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলাম কে আপনি? এখানে কি করছেন?
- দম নিন। বাইরে বৃষ্টি। যাওয়ার জায়গা না দেখে এদিকে গেট খোলা দেখে এসে বসে পড়লাম। আমি ঊষা। আপনি?
- আমি রুদ্র।
- আপনি কি ডোম? লাশ কাটাকাটি করেন?
- নাহ ডোম অন্য কেউ। আমি আপাদত ভারপ্রাপ্ত ইনচার্জ। আপনার পরিচয়?
- বললাম না ঊষা। আজ রাতটা আমি এখানে কাটাই? আপনার সাথে গল্প করি?
মর্গ থেকে বলছি
এস, এম, রাহাত পারভেজ রুদ্র
পর্ব ২
- গল্প! এটা গল্প করার জায়গা? আপনি জানেন আপনি কোথায় বসে? গেটে দেখেছেন কি লিখা আছে?
- হ্যাঁ দেখলাম তো। Here is the place where death delights serving the living. সুন্দর কথাটা। মানুষ নাকী দীর্ঘদিন এক জায়গায় থাকলে ওই জায়গার পরিবেশ তার রন্দ্রে রন্দ্রে মিশে যায়। তা মিস্টার রুদ্র, আপনি কী মাঝে মাঝে দ্বিধায় পড়েন যে আপনি জীবিত বা মৃত কী না তা নিয়ে?
- Welcome to reality. মিথলজির সাথে বাস্তবিকতার কোন মিল নেই। আপনি ঠাকুরমার ঝুলি দিয়ে তো আর বটগাছতলে শাঁকচুন্নির উপস্থিতি অনুভব করতে পারবেন না।
- হা হা হা! বেশ ক্রিটিক্যাল মানুষ আপনি।
- জ্বি, আমার বউ ও বলে।
- ওহ হো! বিয়েও করেছেন!
- কেন? আমাকে দেখে টিনেজার মনে হয়?
- না! ঠিক তা না। খুব ভালোবাসেন বুঝি তাকে?
- জানিনা ভালোবাসি কী না। তবে ওই মেয়ে সব ছেড়েছুড়ে আমার হাত ধরে আমার কাছে চলে এসেছে। তার সব ভালোথাকার দ্বায়িত্ব আমার। আজকাল সে আমার অভ্যাসে রূপান্তরিত হয়েছে।
- এখন বুঝলাম! আপনি ফ্লার্টিং করার ক্ষেত্রে মিসেস রুদ্রকে আনা পরিমাণ ছাড় ও দেন না। বেচারী! আমরা মেয়েরা এসবে আইস্ক্রিমের মতো গলে যাই। হি হি হি।
- শশশশ! সে জানলে আমার গর্দান যাবে। মাঝে মাঝে তাকে চুপ করাতে আধ একটু.... থাক ওসব। আপনি বলুন আপনি এই ঝড়বৃষ্টির রাতে এখানে কী করছিলেন?
- আসলে আমি কাছেই একটা বিউটিপার্লারে কাজ করতাম। আর আমার বাড়ি অনেক দূরের এক পাহাড়ে।
- মানে? আপনি নৃগোষ্ঠীয়?
- হা হা হা। হ্যাঁ।
- আপনার পুরো নাম?
- ঊষা ডাকতে কি খুব বেশি সমস্যা?
- উঁহু আমি জাস্ট জানতে চেয়েছি।
- পাইং চিং ডাকে আমাকে ওখানে। আর পদবী না হয় কাল জানবেন।
- কাল কেন? কাল আপনাকে কোথায় পাবো আমি?
- আরেহ পাবেন পাবেন। এতক্ষন কথা বলে যা বুঝলাম আপনি খুব ই বিচক্ষণ। এটা জানতে খুব একটা সময় লাগবেনা।
- আপনি আমার প্রশ্নের অর্ধেক উত্তর দিয়েছেন। বললেন না তো, এতো রাতে এখানে কি করছেন?
- ওই যে বললাম দূরে বাড়ি। আমি এখানে এসেছি আপনি আসার ঘন্টা দুয়েক আগে।
- আমার আসার সময় আপনি কিভাবে জানেন?
- বাইরে ছিলাম আমি। আপনাকে রিক্সা থেকে নামতে দেখেছি।
- তাহলে যখন দেখেছেন তখন সাড়ে ন'টা হবে। এসেছেন সাড়ে সাতটায়। চলে যাননি কেন?
- আসলে আমাকে যারা নিতে আসার কথা তারা আসেনি। কাল সকালে আসবে। তাই আমার যাওয়া হয়নি।
- আচ্ছা যাই হউক, আপনি সাহসী বটে। লাশকাটা ঘরে এভাবে কেউ আসবে এটা অকল্পনীয়।
- কি জানি। আপনার বাচ্চা আছে?
- হ্যাঁ আমার দু বছরের মেয়ে আছে।
- বাহ! জানেন আমারো না খুব ইচ্ছে ছিল, ছোট্ট একটা ঘর, বর, সংসার। আমারো বাচ্চা হবে।
- এমন ভাবে বলছেন যেন বুড়ো হয়ে গেছেন। সময় হলে সব হবে।
- হা হা হা সময়। এ বড় বিষম বস্তু। সময়ের ভালো ও খারাপ দিক একটাই। সময় চলে যায়। তবে সমস্যা একটা জায়গাতেই, এই সময় যাওয়ার বেলায় আমাদের স্বপ্ন, ইচ্ছে মাঝে মাঝে আমাদের ও সঙ্গে নিয়ে যায়।
আপনি কি সিগারেট ধরাবেন? দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমি একটু দূরে গিয়ে বসি।
বলেই সে মেয়ে উঠে গিয়ে দেয়ালের সাথে লাগানো বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়লো।
এতোক্ষণ ফাইলে মুখ গুঁজে প্রশ্নোত্তর পর্ব চালাচ্ছিলাম। তাই মেয়েটার দিকে খুব একটা তাকানো হয়নি। আমি সিগারেট ধরিয়ে তার দিকে একপলক তাকিয়ে ছিলাম, সে তাকিয়ে ছিল জানালায়। কি সুন্দর চোখ। চেহারায় উজ্জ্বল আলোর আভা। খোলা লম্বা চুল। আকাশী আর হালকা গোলাপী রঙ্গ মিশ্রণের ফ্রগ পড়ে আছে। প্রতিটা বজ্রপাতের ঝিলিক তার গলায়, গালে প্রতিফলিত হয়ে তীক্ষ্ণ তীরের মতো আমার গলায় বিঁধছিল। সেই নাম না জানা ফুলের ঘ্রাণ আরো তীব্রতর হয়ে আমার মস্তিষ্ককে কাবু করে নিচ্ছিল আর অস্বাভাবিক ঠান্ডায় আমার রীতিমত গা কাঁপছিল। আমি নিজের অজান্তেই সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছিলাম। যদিওবা নীলাদ্রি ছাড়া আমার চিন্তা চেতনা কিংবা কামনা বাসনায় কখনোই দ্বিতীয় কোন নারী ঠাঁই পায়নি। মহুর্তেই নীলাদ্রীর চেহারা চোখে ভেসে উঠতেই আমি ঘোর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলাম।
- এই যে মিস্টার! ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কিছুটা লজ্জায় ও পড়ে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলাম :
- না না! অমন কিছুনা। আনমনে একটা কাজের কথা ভাবছিলাম। আচ্ছা কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করবো?
- হ্যাঁ নিশ্চয়।
- বৃষ্টি আপনার খুব পছন্দ?
- উমম! বলা যায়। বৃষ্টির সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক। ঝড় বৃষ্টির রাতে জন্মেছিলাম। যখন ছোট ছিলাম, ঘরের বাইরে মাচাং এ দাঁড়িয়ে বৃষ্টিধারা আর বৃষ্টিস্ন্যাত পাহাড়ের সৌন্দর্যের ভাঁজে হারিয়ে যেতাম।
- তার মানে বেশ রোমাঞ্চকর ভাবেই আপনার ছেলেবেলা কেটেছে।
- জ্বি বলা চলে। গত পরশু থেকে বৃষ্টির এমন তুখোড়তা। আর গত পরশু ই আমার জন্মদিন ছিল।
- ওহহ হো! শুভ জন্মদিন।
- বাসি হয়ে পঁচে গেছে। ঠিক যেমন টা কাল আমি হবো।
- হা হা হা! ঠিক বুঝলাম না।
- অত বুঝতে হবেনা। আমার ভীষণ ভাবে কান্না পাচ্ছে।
- কেন বলুন তো!
- রাতুলের জন্য মন খারাপ হচ্ছে। জানিনা ও কোথায় কীভাবে আছে।
- রাতুল কে?
- রাতুল হচ্ছে যে আমার জীবনে পদার্পণের পর আমি আমার নারীত্ব বুঝতে পেরেছি। কিশোরী থেকে কখন যুবতী হয়েছি তা রাতুল আমার জীবনে না আসলে বুঝতাম ই না।
- আপনার প্রেমিক?
- সব যদি ভেঙ্গে বলতে হয় মশাই তবে আপনাকে একটু আগে বিচক্ষণ বলাটা আমার ভুল বলে ধরে নিব।
- তো এভাবে মন খারাপ করার কি আছে? ফোন করুন তার কাছে!
- আমার ফোন কোথায় আমি জানিনা।
- আমার নাম্বার থেকে কল দিন।
- ওর নাম্বার আমার জানা নেই।
(ফোনে তাকিয়ে দেখি রাত ২ টা ০৫। ভাবলাম অটোপসি রুমটা একবার ঘুরে আসি।)
- ওহ হো! ভারি বিপত্তিকর অবস্থা। আপনি বসুন আমি বাইরে থেকে একপাক ঘুরে আসি।
- আচ্ছা।
আমি বের হয়ে অটোপসি রুমে দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। স্ট্রেচারে দুটো ডেথবডি রাখা। আর কাউকে দেখছি না। দু পা সামনে বাড়িয়ে ডানে তাকাতেই দেখি রতন আর মাজেদ মিলে বিড়ি ফুঁকছে। আমি কিছু না বলে পিছু ফিরে রুম থেকে বের হতেই দেখি ঊষা দাঁড়ানো। আরেকটুর জন্য ধাক্কা খেতে খেতে নিজেকে সামলে নিলাম।
- আপনি এখানে?
- হি হি হি! লাশের সাথে আপনার সখ্যতা দেখতে এলাম।
- আমি আচমকা ভয় পেয়ে গেছি।
- ও বাবা! আপনি ভয় ও পান?
- কেন? আমি মানুষ না?
- আমি কী জানি। আমি ভয় পাই না!
- কেন আপনি মানুষ না?
- নাহ! আমি অশরীরী। হি হি হি।
- ধুর!
ফোন ভাইব্রেট করতে পকেট থেকে বের করে দেখি রাশেদ ভাইয়ের কল।
- হ্যালো।
- রুদ্র! ওদিকে সব ঠিক আছে?
- হ্যাঁ ভাই। সব ঠিক। আপাদত প্রেতাত্মাদের সাথে ডিনার শেয়ার করছি। সাথে শ্যাম্পেইন। একটু পর যুম্বা ড্যান্স হবে। আসবেন নাকী?
- হা হা হা হা! না ভাই! আমার ভুতের সাথেও নাচা মানা। তোমার ভাবি আমার আস্ত রাখবেনা। কোন সমস্যা হলে জানিও।
- ভাই আমি মরে গেলেও আপনি এখন আসতে পারবেন না আমি জানি। নিছক শান্তনা আমার পছন্দ না ভাই।
- রাগ করোনা ভাই। তোমার ভাবি ঝড় বৃষ্টিতে একটু বেশি ভয় পায়। রাগ করোনা ভাই।
- সমস্যা নাই ভাই। আপনার সাথে থাকলে বিরক্ত হতাম। ভালোই হয়েছে চলে গেছেন। আমি এক সুন্দরীর কোম্পানি পাচ্ছি।
- হা হা হা! এই মাঝ রাতে মর্গে সুন্দরী! আচ্ছা আচ্ছা। এনজয়.....
ফোন রেখে চারপাশে দেখি মেয়েটা নেই। একটু দূর এগুতে দেখি গেটের কাছে মেয়েটা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়ানো আর তাকিয়ে আছে দূরান্তের অন্ধকারে।
তার চোখে কোন বিম্ব নেই। উদাস দিগন্ত লেপ্টে আছে তার চোখে মুখে। মেয়েটা অদ্ভুত সুন্দর। অদ্ভুত মাতাল করার ফুলেল শুভাস ছড়াচ্ছে মেয়েটার গা থেকে। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে গুটিপায়ে এগিয়ে সামনে গেলাম।
মর্গ থেকে বলছি এস, এম, রাহাত পারভেজ রুদ্র পর্ব ৩
- নীলাদ্রীকে খুব ভালোবাসেন তাই না?
- হ্যাঁ! তাই হয়তো ধরে বেঁধেই রেখেছি নিজের কাছে।
- বুঝলাম না ঠিক। আপনার প্রেমের গল্প বলুন। শুনি।
- এতো আগ্রহ যে?
- আসলে মানুষের জীবনে উত্থানপতন আছে। আর এসব ডিঙ্গিয়ে কেউ কারো পাশে আছে এসব শুনলেও মনে তৃপ্তি আসে।
- আমি এই শহরে নতুন এসেছিলাম পড়াশুনোর তাগিদে। মাস দুয়েক হোস্টেল থেকে বের ই হতাম না। তারপর জুটে গেলো দুটো টিউশন। আমি যে সময়টায় টিউশনে যেতাম ওই সময়টায় প্রায়শ রাস্তায় একটা ছেলে ফোনে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকতো সিগারেট হাতে।
- বখাটে?
- না না। অমন না। সে নিজের মতোই থাকতো। সেদিন ও আমার জন্মদিন ছিল। আর এমন ই ঝুম বৃষ্টির এক সন্ধ্যা।
- হা হা হা, আসলেও বৃষ্টির সাথে আপনার জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক।
- আমি তা আগেই বলেছি... তো সেদিন টিউশন থেকে বেরিয়ে গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। আচমকমা মোড়ে যেতেই বৃষ্টি আর বজ্রপাত। আমি ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলি। চোখ খুলতে দেখি ওই ছেলেটা আমার মাথায় ছাতা ধরে আছে। কিন্তু তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। আমি কথা না বলে আমার ব্যাগ বুকে জড়িয়ে গলির মুখে এলাম। ছেলেটা রিক্সা ডেকে আমাকে তুলে দিয়ে যে পথে এসেছি সে পথে চলে গেলো। পুরোটা সময় জুড়ে সে একবারো আমার দিকে ঘুরেও তাকালো না।
- ছেলের চোখ হয়তো ত্যাড়া। দেখেছে ঠিক ই আপনি বুঝেননি।
- উফফ না। ও চুপচাপ আর চাপা স্বভাবের।
- আচ্ছা আচ্ছা! তারপর?
- তারপর সারা রাত ছেলেটার কথা মনে পড়ছিল। এপাশ ওপাশ করে রাত পার করে দিলাম। পরদিন থেকে প্রায় দশ বারো দিন ছেলেটাকে কোথাও দেখলাম না। তারপর একদিন আমি টিউশন শেষ করতে একটু দেরি হয়ে যায়। গলিতে কিছু ছেলে আমার পিছু নেয়। আর কিছুদূর যেতেই আমাকে ঘিরে ধরে। আমি ভয়ে কাঁপছিলাম আর চার দিকে তাকাচ্ছিলাম। আচমকা দেখি ওই ছেলে গুলো ভৌদৌঁড়। পেছনে ফিরে দেখি ওই ছেলেটা দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে সিগারেট আর ডান দিকে মাথা হেলিয়ে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। আমার ভয় তখনো কমেনি। ছেলেটা হাঁটতে ইশারা দিল। আমি সামনে সামনে হাটছি। আর সে পেছন পেছন। গলির মুখে আবারো সে রিক্সা ডেকে আমাকে তুলে দিল, আর সে নিচের দিকে তাকিয়েই একই রাস্তায় ফিরে গেলো।
- এহ! আমার মনে হয় ছেলের ঘাড়ে সমস্যা।
- বললাম না, ও চাপা স্বভাবের।
- তারপর বলুন, কি হলো?
- তারপর দুদিন ওই ছেলে লাপাত্তা। তৃতীয় দিন তাকে পেলাম ওই জায়গাতে। ফোনে মুখ গুঁজে হাতে সিগারেট। গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। তাও দেখি সে মাথা তুলছেনা। আমি গলা ঝাঁকি দিতেই সে হচকচিয়ে উঠলো। ফোন পকেটে নিয়ে সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।
- আপনার নাম কি?
- রাতুল
- কি করেন?
- কিছু করিনা। বেকার
- পড়াশুনা?
- মাস্টার্স শেষ করেছি সদ্য।
- তো চাকরী করছেন না কেন?
- ইচ্ছে নেই।
- এমন প্রতিবন্ধি মার্কা কেন আপনার চলা ফেরা?
- জানিনা। আমি এমন ই।
- আপনাকে ধন্যবাদ দিতে এলাম। পরপর দুবার আমাকে সাহায্য করে গলির মুখ অব্দি ছেড়ে আসাএ জন্য।
- তার কোন প্রয়োজন নেই।
- সে যাই হউক। আমি ঊষা।
- আমি রাতুল। যাই আমি কাজ আছে একটা।
আরেহ শুনুন শুনুন......
রাতুল চলে গেলো, আজকেও আমার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি।
রাতুলের ওভাবে চলে যাওয়ায় কেমন যেন রাগ জন্মে গেছিল তার উপর। তারপর অনেকদিন দেখা সাক্ষাত নেই। আমি রোজ খুঁজতাম তাকে। বেশ কয়েকদিন পর গলির মুখে রিক্সায় উঠতেই রাতুল আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।
- কিছু বলবেন মিস্টার রাতুল?
- চেপে বসুন। আমি সামনে যাবো।
- আচ্ছা উঠুন।
- ধন্যবাদ।
রিক্সা চলতে শুরু করলো। ল্যাম্পপোস্ট গুলোকে ছাড়িয়ে শহুরে রাস্তার বুক চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছিল রিক্সা। আমি আড় চোখে রাতুলের দিকে তাকিয়ে। আর সে চেয়ে আছে রিক্সার প্যাডেলের দিকে। শুনশান নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম,
- আপনি সব সময় নিচের দিকে তাকিয়ে থাকেন কেন?
- কারণ তো নিশ্চয় আছে।
- কী কারণ?
- প্রয়োজন হলে সময় হলে জানবেন।
- আপনার ফোন নাম্বার টা দেয়া যাবে? কখন কোন বিপদে পড়ি তা তো জানিনা। এ শহরে আমাকে সাহায্য করার মতো আপনি ছাড়া আর কাউকে দেখিনা।
- আচ্ছা ফোন দিন।
........ এটা আমার নাম্বার। আমি এখানে নামছি। লিফটের জন্য ধন্যবাদ।
রাতুলের প্রতি দিন দিন আমার অদ্ভুত মায়া জন্মে গেলো। ভালোবাসা কি না জানিনা। তবে ছেলেটাকে ভীষণভাবে আগলে রাখতে মন চাইতো।
- হুম বুঝলাম! চা খাবেন?
- জ্বি না। রাতুলের সাথে টং চা খাওয়ার অনেক স্মৃতি থাকলেও আমি এখন আর চা খাওয়ার অবস্থায় নেই।
- আহহ কলির রাধা.. তারপর বলুন।
- তারপর মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো। ও রোজ রাস্তার ধারে দাঁড়াতো। রোজ ই আমি তাকে দেখতাম। সে আমার দিকে তাকাতো না। দীর্ঘদিন এভাবে চলার পর আমি কেমন যেন ধীরে ধীরে নিজেকে তার ভেতর হারিয়ে ফেলতে শুরু করলাম। কিন্তু ভয় আর বাঁধা এক জায়গাতেই। আমাদের ধর্ম আর জাতি আলাদা... হুট করে এক রাতে সে আমাকে ফোন দেয়।
- ঊষা
- হ্যাঁ
- বাইরে আসা যাবে? আমি আপনার হোস্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে।
- জনাব এটা হোস্টেল। ৯ টার পর বের হওয়া অসম্ভব। এখন রাত দেড় টা প্রায়।
- আমার কিছু বলার ছিল।
- ফোনে বলা যায় না?
- নাহ, সামনাসামনি বলতে হবে।
- আচ্ছা কাল সকালে?
- সকালে কয়টায় বের হতে পারবেন?
- ৫ টায় গেট খোলে।
- আমি অপেক্ষা করছি এখানে। গেট খুললে আমার সাথে এসে দেখা করবেন।
- আরে পাগল নাকি আপনি? এতক্ষণ কি করবেন বাইরে?
- ৫ টা। গেট খুললে এসে দেখা করবেন। রাখছি....
ফোন কেটে দিল সে। জানালা দিয়ে দেখলাম ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে বসে আছে রাতুল। কেমন যেন অপরাধবোধ হলো। শুয়ে ছিলাম ঠিক। দু চোখের পাতা এক করতে পারিনি। ভোরে গেট খুলতেই দৌঁড়ে গেলাম তার সামনে। ছেলেটা সত্যিই সারা রাত বসে ছিল।
- এইই আপনি পাগল? কি এমন কথা যার জন্য সারা রাত আপনি এখানে বসে?
- ঊষা! আমার নিজের বলতে কেউ নেই। আমার মা মারা যান ছোট বেলায়। তারপর থেকে আমার বাবার নারীতে আসক্তি। ছোটবেলা থেকেই আমি লোকের মুখে নিজের বাবার কূকীর্তি নিয়ে শুনে এসেছি বারংবার। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যাকে জীবন সঙ্গীনী রূপে পাবো তাকে ছাড়া আর কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবোনা। তাই আমার চোখ সব সময় নিচের দিকে থাকে।
- বুঝলাম। সেদিন উত্তর দিয়ে দিলেই পারতেন। সারা রাত এখানে বসে ছিলেন এটা বলতে? পারেন ও বটে মশাই।
- না, আমার অন্য কিছু বলার ছিল।
- বলুন তাহলে...
- আমি আমার জীবনে একজন মেয়েকেই চোখ তুলে দেখে ফেলেছি। তাও ভুল করে।
- কাকে?
- আপনাকে।
- কখন!!
- যেদিন আপনি রিক্সা থেকে নেমে বাইক স্লিপ করে পড়ে যাওয়া একটা ছেলেকে টেনে তুলছিলেন, সেদিন। স্লিপ করে যাওয়া হেলমেট পড়া ছেলেটা আমিই ছিলাম।
- আচ্ছা! এজন্য আমাকে আপনি বারবার সাহায্য করে যাচ্ছিলেন?
- ঠিক সাহায্য না। আমি সেদিনের পর আপনাকে রোজ দেখতাম। কিন্তু সামনে আসতাম না। যাই হউক, আগেই বলেছি, আমার নিজের বলতে কেউ নেই। আপনি কি আমার হবেন? আমি আপনি বৈ দ্বিতীয় কোন নারীর দিকে তাকাতে চাইনা। আমিও এ আঁশে বাঁচতে চাই, আমার নিজের মতো করে বলার কেউ আছে।
- আমার কাজ আছে। পরে কথা হবে। গেলাম আমি।
কোন মতে এ কথা বলে দৌঁড়ে চলে এলাম রুমে। আমার পুরো শরীর কাঁপছিল। হয়তো আমিও তাকে ভালোবাসি। কিন্তু ওকে স্বীকৃতি দেয়া আমার পক্ষে এক পর্যায়ে অসম্ভব ই।
সেদিন ই আমি বাড়ি চলে গেলাম। আর ফোন বন্ধ রাখলাম সে কদিন, যে কদিন বাড়িতে ছিলাম।
মর্গ থেকে বলছি এস, এম, রাহাত পারভেজ রুদ্র পর্ব ৪
- তারপর?
- তারপর আর কি! আমি তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করি। কারণ তার প্রতি অনুভূতি থাকলেও আমার ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ছিল আমার প্রতিবন্ধক।
- তাহলে?
- আমি ভেবেছিলাম কদিন এড়িয়ে চললে সে নিজেকে সামলে নিবে। কিন্তু সে আমার উপর রেগে ছিল। রাগের কারণ টাও স্বাভাবিক। আমার ভেতর কেমন যেন অপরাধবোধ কাজ করছিল। দিন দশেক পর আমি তাকে ফোন দিলাম। রিং হওয়ার সাথে সাথেই কল রিসিভ করে পাগলের মতো চিৎকার চেঁচামেচি শুরু। আমি চুপচাপ শুনলাম। (মনে মনে ভাবলাম দেখা করে সব বুঝিয়ে বলি)।
- কাল দেখা করবেন?
- কেন?
- আমার কথা ছিল।
- আচ্ছা, কোথায় আসবো?
- ঝিলের ধারে?
- কখন?
- সন্ধ্যায়?
- আচ্ছা।
সেদিন সন্ধ্যায় আমি গেলাম ঝিলের ধারে। পৌঁছে দেখি ঝিলের ধারে বসে পাথর ছুঁড়ে মারছে ঝিলের বুকে।
- শুনছেন?
- হুম বলুন।
- আপনি রেগে আমার উপর? (ছেলেটা তখনো মাটির দিকে তাকানো)
- উঁহু! অনধিকার চর্চা করতে রাজী না।
- দেখুন আপনি আমার ব্যাপারে কিছুই জানেন না!
- থাক আর কিছু বলতে হবেনা।
- দেখুন আমি নৃগোষ্ঠী। আপনার ধর্মের না।
- তো?
- আমার জাতি এসব ব্যাপারে খুব কঠোর। আমি আমার পরিবার হারাবো। জাত পাত সব হারাবো যদি আপনার প্রস্তাবে সাড়া দেই।
- থাক সাড়া দিতে হবেনা।
- দেখুন আমিও আপনাকে পছন্দ করি। কিন্তু আমি আপনাকে আগলাতে গিয়ে আমার সব হারাতে হবে।
- ক্ষমা করবেন। আসলে আমি স্বার্থপর। আপনি আপনার সব নিয়ে থাকুন। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা।
- আপনি এভাবে বলছেন কেন?
- আমার অপরাধ, আমি শুধু একবারের জন্য আশ্রয় চেয়েছিলাম। আপনি বলেছিলেন, পাগলামীর ও একটা সীমা থাকে। সেই নিজে নিজেকে হারিয়ে এলাম, আর খুঁজে পাইনি।
- রাতুল! একটা বার আমার হাত ধরবেন?
- হা হা হা! ক্ষমা করবেন। আমি একবার আপনার দিকে তাকিয়ে জীবন উচ্ছন্নে! হাত ধরলে বাঁচার অবশিষ্ট আশাও থাকবেনা।
- আমি এক শর্তে থাকতে পারি।
- কী?
- আমাকে আজীবন নিজের কাছে আগলে রাখতে হবে। আমার আপনি ছাড়া আর কেউ থাকবেনা।
- বিয়ে করবেন আমাকে?
- আমি জানিনা।
- কাল দুপুর ১২টায় হোস্টেলের নিচে আসবো আপনাকে নিতে।
- কেন?
- আমি আপনাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। আমার আপনি ছাড়া কেউ নেই। তাই আপনাকে বরাবরের মতো নিজের করে নিতে চাই।
- আমি যাই অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে।
- আমি আসবো ১২ টায়।
- আচ্ছা
সেদিনের মতো চলে এলাম। অদ্ভুত ছেলেটা আজকেও আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো না। আমার অন্তরাত্মা কেঁপে কেঁপে উঠছিল; আবেগের বশে কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না তো! আমি জানিনা, তবে অদ্ভুত মায়া জন্মে গেছে তার প্রতি। যা হবে হউক, আমি ছেলেটাকে ছাড়ছি না....
রাতে ঘুমোতে দেরী হওয়ায় আমার ঘুম ভাঙ্গে দশটার দিকে। ১৩ টা মিসড কল আর ৯ টা টেক্সট জমে আছে। টেক্সটে লিখা ছিল - যদি পারেন তো শাড়ি পড়ে বের হবেন।
আমি শাড়ি পড়ে বাধ্য বালিকা হয়ে নিচে নেমে দেখি উজবুক টা নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকোচ্ছে।
আমাকে দেখে বাইক স্টার্ট দিয়ে ইশারা দিলো বাইকে উঠতে। আমি সুড়সুড় করে চেপে বসলাম। বাইক গিয়ে থামলো কাজী অফিসের সামনে। নামতেই ৫/৬ জন ছেলে মেয়ে আমার গায়ে গোলাপ পাপড়ির অভিষ্যন্দী জানাচ্ছিল। আমার কাছে মোটামুটি সব স্বপ্নের মতোই মনে হচ্ছিল। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না, আদৌ কি হচ্ছে! অথবা হতে যাচ্ছে।
রেজিস্ট্রিতে সাক্ষরের পর রাতুল তার বাম হাত দিয়ে আমার ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। বিশ্বাস করুন, ওই স্পর্শে আমি ভরসা আর ভালোবাসার ছোঁয়া পাচ্ছিলাম। রেজিস্ট্রির সব শেষ করে সে উঠে দাঁড়ালো। আমার এখনো চোখে ভাসে, আমার রাতুল তখন প্রথমবার আমার দিকে মুখ তুলে তাকায়। তার ঠোঁটের কোণে হাসি আর চোখের কোণে টলমল পানি। আমি অবচেতন মনে জাপ্টে ধরতেই নিস্তব্ধ মহাশুন্যতা বাঁধ ভাঙ্গে আমাদের দুজনের কান্নার হুঁহুঁ শব্দে.......
মর্গ থেকে বলছি
এস, এম, রাহাত পারভেজ রুদ্র
পর্ব ৫
রাতুল আমাকে নিয়ে গেলো তার বাসায়। সুন্দর বিলাসবহুল বাড়ি হলেও যত্নের অভাবে পুরোনো স্টোর রুমের মতো হয়ে আছে। শুরু হলো আমাদের ছোট্ট সংসার। প্রতিটা দিন আমার কাছে স্বৈর্গিক মনে হচ্ছিল। আমি ভুলেই গেছিলাম আমার পরিবার আর ছোট্ট পাহাড়টার কথা, যেখানে আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা।
মাঝে মাঝে বাড়িতে যেতাম। শেষবার বাড়িতে যাই গত ৬ দিন আগে। আমি তখন ৪ মাসের অন্তঃস্বত্তা। কী ভুলো মন আমার, আমার প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট আমার ব্যাগে। আর তা আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। আমার মায়ের হাতে পড়ে যায় সে রিপোর্ট।
মিস্টার রুদ্র আপনার ফোন বাজছে....
- ওহ খেয়াল ই করিনি। (ফোন হাতে নিয়ে দেখি নীলাদ্রীর ফোন।) রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বাবা বললেন, শুভ্রা (আমার ছোট বোন) হস্পিটালাইজ। লেবার পেইন উঠেছে। আমি বাবাকে শান্তনা দিয়ে বললাম, ভয়ের কিছু নেই। আমি বিকালে আসছি। আপনি ভোর হলেই হাসপাতালে চলে যান। ভালো মন্দ আমাকে জানাবেন। নীল আছে পাশে? ওকে দিন....
- হ্যালো
- তুমি আব্বুকে সকালে রেডি করে পাঠাই দিও হস্পিটাল। সবাই হাসপাতালে ভিড় করার দরকার নেই। আমি কাজ গুলো সেরে সন্ধ্যা নাগাদ চলে আসবো। তোমাকে নিয়ে তারপর আমি বের হবো।
- আচ্ছা.....
ফোনে কথা বলতে বলতে রুম ছেড়ে কখন যে অটোপসি রুমের সামনে চলে এসেছি সে খবর নেই। রুমের ভেতর মাজেদ দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুম। রতন কে কোথাও দেখলাম না। ফজরের আজান হচ্ছে। ভাবলাম রুমে গিয়ে নামাজটা পড়ে নিই। রুমে গিয়ে দেখি ঊষা নেই। চারদিকে খুঁজেও তার সাড়াশব্দ পেলাম না। তার শরীর থেকে আসা ফুলেল সৌরভের ও কোন চিহ্ন নেই। খুব রাগ হচ্ছিলো মেয়েটার উপর। সারা রাত ঘুম হারাম করে যাকে সঙ্গ দিলাম সে যাবার বেলায় সামান্য সৌজন্যতা দেখানোর ও প্রয়োজনবোধ করলো না। নামাজ শেষ করে চেয়ারে বসে ভাবছিলাম আমার বোনের কথা। আল্লাহ ই জানে কোন অবস্থায় আছে। ভাবতে ভাবতে চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল সাড়ে আট টায় ঘুম ভাঙ্গে রতনের ডাকে। নাস্তা নিয়ে এসে ডাকছে আমাকে। সারাটা রাত কিভাবে কাটলো কি হলো না হলো আমার সব স্বপ্নের মত লাগছিল। আমি ফোন বের করে বাবাকে ফোন দিলাম।
- রুদ্র, আমি তোকে কল করতেই যাচ্ছিলাম
- আব্বু কি হইছে?
- শুভ্রার ছেলে হয়েছে। তুই মামা হয়েছিস ব্যাটা। আমি নানা, হা হা হা।
- ওরা কেমন আছে আব্বু?
- নরমাল ডেলিভারি, দুজনেই ভালো আছে। কাজ সেড়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়।
- আব্বু আমি যত তাড়াতাড়ি পাড়ি চলে আসবো।
- রাখ, আমি সবাইকে খবর টা দিই।
বাবা ফোন কাটতেই আমি নীলাদ্রীকে ফোন দিলাম। ফোন না তোলায় টেক্সট করলাম। ফ্রেশ হয়ে গেলাম খেতে। খাওয়ার মাঝপথেই বাইরে হট্টগোল। লাশের পরিবারের সদস্য লাশ নিয়ে যেতে চাচ্ছে। দ্বায়িত্বরত দুজন পুলিশ কনস্টেবল ছিল তাদের ও মানতে নারাজ তারা।
গিয়ে বুঝিয়ে বললাম। নাম ঠিকানা নিয়ে রুমে এসে রমজান ভাইকে ফোন দিলাম, রমজান ভাই কেটে দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে রুমে ঢুকে সালাম দিলো। জিজ্ঞেস করলাম ১৬৭২ নাম্বার বডির কেস কি?
- ওইডা স্যার? বুরা কাকু। গলায় দড়ি দিছে।
- ১৬৭১?
- ওইডা বিষ খাওয়া।
- কেউ আসছে?
- নাহ স্যার। ১৬৭২ টা আগে করে দিন।
- স্যার ঠিক আছে।
- যান শুরু করে দেন। রাশেদ ভাই আসছে?
- হ স্যার। উনি আছে ওইহানে।
- আচ্ছা যান। আমি আসছি ফাইল রেডি করে।
- আইচ্ছ্যা স্যার।
ফাইল টা চেক করে অটোপসি রুমে গেলাম। ১৬৭২ প্যাশেন্টের রিপোর্ট রেডি করে হেড স্যারের সাইন নিয়ে ৩ টা কপি ৩ টা ডিপার্টমেন্ট এ পাঠিয়ে বডি হ্যান্ড ওভার করে দিলাম।
এর মাঝে ৩ জন এসে হাজির ১৬৭১ নাম্বার বডির। আমি তাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে ঢুকলাম আবারো অটোপসি রুমে। ২৩/২৪ বছর বয়সী মেয়ের লাশ স্ট্রেচারে। সাধারণত মহিলা ডেডবডি আসলে আমি চোখ ঘুরিয়ে রাখি। আমার সামনে নগ্ন দেহ শুধু নীলাদ্রীর প্রতিচ্ছবি ভাসিয়ে তোলে। আমাকে সব ইনফো দিচ্ছিলো রাশেদ ভাই আর আমি ডাটা এন্ট্রি করছিলাম রিপোর্ট কার্ডে। স্ক্যাল ইন্সিশন শেষে চোখ চোখ গেলো বডির চেহারায়। হুট করেই কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। এ চেহারা আমার পরিচিত। এটা তো ঊষা। যে সারাটা রাত আমার সঙ্গে ছিল। আমি দৌঁড়ে বেরিয়ে এলাম। ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে পানি ঝাপ্টা দিয়ে সব কিছু হ্যালুসিনেশন ভেবে উড়িয়ে দিতে চাইলাম। আবার গেলাম অটোপসি রুমে। গিয়ে কেস ফাইল হাতে নিয়ে পাইং চিং মান্দি। তার মানে ঊষা ই।
ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর সময় গতকাল বিকাল ৪:২০। আর মর্গ এন্ট্রি সন্ধ্যে ৭:৩০। সময় সিকুয়েন্স গুলো আমার কাছে ধোঁয়াটে মনে হচ্ছিলো। আমি আরো কাছ থেকে ঊষার চেহারার দিকে তাকালাম। সে সৌন্দর্য বিষাক্ততায় নীলছে বর্ণ ধারণ করেছে। ঠোঁট শুকনো আর স্কাল ইন্সিশনের কারণে দেবে যাওয়া চোখ। আমার হাত পা কাঁপছে.......
আমি এই প্রথম অটোপসি রুমে ভয়ে, আতঙ্কে কাঁপছিলাম। অবশ্য ভয় না, আমি গতকাল রাত ১২ টা আর দুপুর ১২ টার সামঞ্জস্যতা পেয়েও পাচ্ছিলাম না। যে গতকাল বিকালে মারা গেছে সে রাতে কিভাবে আমার সাথে ছিল। ইন্সেকশন প্রায় শেষের পথে। রাশেদ ভাই বললেন, বডির পিরিয়ড স্টেজ ছিল। জমাট বাঁধা ব্লাড দেখা যাচ্ছে।
মহুর্তেই আমার মনে পড়লো ঊষা বলেছিল সে চার মাসের গর্ভবতী। আমি রমজানকে ইশারা দিলাম ইনসেশন কাট তলপেট অব্দি আরো নিচে নামাতে। রাশেদ ভাই জিজ্ঞেস করলেন, - তুমি কি ধর্ষণ বলে সন্দেহ করছো? আমি শুধু উঁহু বলে মাথা নাড়ালাম।
তলপেট কাটতেই গর্ভাশয় দেখি ফোলা, স্ক্যাল্পার দিয়ে হালকা করে কাট দিতেই বেরিয়ে এলো ৪ মাসের ভ্রুনের বাম পায়ের হাঁটু। এই প্রথম কারো লাশ নিয়ে আমার বুক কাঁপছে। হার্টরেট বাড়ছে। আমি অটোপসি রুমের ডেস্কে গিয়ে বসলাম। একটু পর রাশেদ ভাই জানালেন, বাচ্চা নষ্টের চেষ্টা করা হয়েছিল। তাই ব্লিডিং। কিন্তু আরেকটা ফ্যাক্ট।
আমি চোখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি?
রাশেদ ভাই জানালেন, তাকে ধর্ষণ ও করা হয়েছে। তাও গতকাল। সময় অনুমান করা যাচ্ছেনা ব্লাড আর সিমেনের মিশে যাওয়ার কারণে। আমি রিপোর্টের ১ কপি নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে 'ঊষার পরিবারের কে আছেন, রুমে আসুন বলতে বলতে রুমে ঢুকলাম। দুজন আমার রুমে এলো। জিজ্ঞেস করলাম,
- ঊষার সাথে আপনাদের সম্পর্ক কি?
- আমি তার বাবা। আর ও তার ভাই।
মহুর্তেই ঊষার ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো, তার নাম যে ঊষা আপনি কিভাবে জানেন? সব জায়গায় পাইং চিং মান্দি লিখা।
কিছুটা বিব্রতভাব নিয়ে উত্তর দিলাম,
- আপনারা ফোনে বলছিলেন তখন শুনেছি।
- ওহহ আচ্ছা
- আপনার নাম কি?
- আখং চিং মান্দি
- দেখুন আংকেল নিজেকে শক্ত রাখুন। আপনাকে শান্তনা দেয়ার ভাষা আমার নেই। তবে না বললেও নয়, আপনার মেয়ে ৪ মাসের অন্তঃস্বত্তা সে সাথে তাকে দুদিন আগে ধর্ষণ করা হয়েছে। আমরা সিমেন স্যাম্পল পেয়েছি।
মর্গ থেকে বলছি
এস, এম, রাহাত পারভেজ রুদ্র
পর্ব ৬ (শেষ পর্ব)
সব কিছু অগোছালো, উদ্ভট আর নাটকীয় মনে হচ্ছিলো। আমি শারমিন ম্যাম কে ফোন দিয়ে ছুটি চাইলাম এবং সব কিছু খুলে বললাম। ম্যাম আমার উপর কিছুটা রেগে আছেন। কেন তা জিজ্ঞেস করলেও বললেন না। শুধু বললেন যাও ঘুরে আসো। বের হয়ে রিক্সায় উঠে বাস স্ট্যান্ড যাই। ফোনে দেখি নীলাদ্রীর ৫৬ টা মিসড কল। আবারো রিং হচ্ছে। এই প্রথম আম ইচ্ছা করে তার ফোন রিসিভ করলাম না। টিকিট কেটে বাসায় গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বাস স্ট্যান্ড গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বাস চলে এলো। বাসে চেপে জানালার পাশের সিটে বসে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলাম রাস্তার ধারে। এই প্রথম আমার মনে হচ্ছিল আমি মর্গে কিছু ফেলে যাচ্ছি। এই প্রথম আমার নীলাদ্রীর কাছে যাওয়ার কোন উৎফুল্লতা নেই। ফোনে আবারো রিং হচ্ছে। শারমিন ম্যামের ফোন।
ম্যাম বললেন
- রুদ্র! তোমার এখনো অনেক কিছু শেখা বাকী। মেডিকেল এর যে কোন শাখাই হউক, সেখানে আবেগের কোন জায়গা নেই।
- ম্যাম আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করবো।
- বাদ দাও। পরশু এসে দেখা করো।
বাড়ি পৌঁছে গোসল সেরে নীলাদ্রীকে নিয়ে হস্পিটালে গেলাম। আমি জানিনা আমার ভেতর কোন খুশি বা আবেগ কাজ করছেনা। আমার মন পড়ে রয়েছে অটোপসি রুমের স্ট্রেচারে। শুভ্রাকে বাসায় নিয়ে এলাম। জামা চেঞ্জ করে শুয়ে পড়লাম। বুকে চিনচিন ব্যাথা। আয়াত অনেকক্ষণ ধরে আমার বুকের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছিল। আমি অনেকাংশ অসার মৃতদেহের মতো পড়ে রইলাম। নীলাদ্রী এসে বেশ কিছুক্ষণ ধরে বকাবকি করে আয়াতকে নিয়ে চলে গেলো। আমি তখনো নির্বাক। অনেকক্ষণ পর বাতি নিভিয়ে আয়াতকে দোলনায় শুইয়ে নীলু আমার পাশে শুয়ে আমার গলায় মাথায় হাত দিয়ে দেখলো। নীলুর একটা অভ্যাস সে সব সময় শুয়ে আমার টিশার্টের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে ঘুমায়। আমিও ডান হাত দিয়ে তার হাতটা চেপে ধরে রাখি।
কিছুক্ষণ পর আমি নিজেকে ড্রয়িং রুমে আবিষ্কার করলাম। সামনে ঊষা বসা। নিজের ঘরের সব কিছুই অপরিচিত বলে মনে হচ্ছিলো।
- মিস্টার রুদ্র
- আমার কাছে সব অস্পষ্ট। আপনি বেঁচে নেই। আপনি আমার সামনে কী করে হতে পারেন?
- এসব নিয়ে কথা বলার সময় এটা না!
- আপনার মৃত্যুর পেছনে কী তাহলে রাতুলের হাত রয়েছে?
- হা হা হা! এখনো আপনার এটা মনে হয়?
- আমার সন্দেহ আপনার পরিবার এবং রাতুল।
- জ্বি না! রাতুল না। আবার আমার পরিবারের সবাই ও না। শুধুমাত্র আমার বাবা।
- মানে?
- হ্যাঁ! আমার ভাই অনেক চেয়েছে আমাকে বাঁচিয়ে নিতে। আমার বাবা জোরপূর্বক আমাকে বিষ খাইয়েছিল।
- সেটা তো আগে বললেই পারতেন। এখন তো আপনার শরীর ও সমাহিত করা হয়ে গেছে।
- সমাহিত না! দাহ করা হয় আমাদের রীতিতে।
- আমাকে ক্ষমা করবেন।
- এখানে তো আপনার দোষ দেখছিনা। আমার হাতে সময় নেই। আমার যেতে হবে। আমার রাতুল হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা নড়ছে। পারলে ওকে বাঁচিয়ে নিন।
ঊষার অবয়ব বাতাসে মিশতে শুরু করেছে। সাথে তার কণ্ঠস্বর ও আবছা হয়ে আসছে।
প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। নীলাদ্রী আর আয়াত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলাম। আমি ভোর হতেই উঠে আবারো ছুটলাম কর্মস্থলে। রাতুলকে খুঁজে বের করতে হবে। পৌঁছে সব ওয়ার্ডে খবর নিলাম। সে নামের কেউ ছিল না। শারমিন ম্যাম আমাকে হয়তো দেখেছেন সকালে। ফোন দিয়ে দেখা করতে বললেন.... আমি চলে গেলাম হাসপাতালের পেছনে, মর্গের দিকে.... মাথায় শুধু ঊষা রহস্য....
- আসসালামু আলাইকুম ম্যাম
- এসো রুদ্র..........! তোমার তো আজ ছুটি ছিল! তুমি না বাড়ি গিয়েছিলে?
- ম্যাম, আমি মানসিক স্থবিরতা পাচ্ছিনা। ১৬৭১ নাম্বার কেস টা নিয়ে।
- আমি ক্লাস টা নিয়ে আসি। একটু আগে বডি এসেছে। সেটা দেখো। তন্ময় ও আছে। রিপোর্ট ওকে লিখতে দিও। তুমি শুধু তাকিয়ে দেখবে।
- আচ্ছা ম্যাম।
- খেয়েছো?
- না ম্যাম।
- খেয়ে নাও। আমার ৩ টা থেকে ৫ টা ক্লাস। তারপর এসে কথা বলছি....
- ওকে ম্যাম আসসালামু আলাইকুম।
ম্যাম উঠে চলে গেলেন। আমি পেছনের গেটে গিয়ে সিগারেট ধরিয়ে আনমনে ডুব দিলাম ঊষা রহস্যে।
রতন পেছন থেকে ডাকছিল। ঘাড় ফিরাতেই বলে, স্যার খাবার টেবিলে আছে। লাঞ্চ করে নেন। চোখ মুছে যাচ্ছিলাম খাবার খেতে। আমি রুমে ঢুকে হাত ধুয়ে বসলাম খেতে। আর এক ভদ্রলোকের তড়িঘড়ি করে রুমে প্রবেশ।
- স্যার স্যার।
- জ্বি বলুন
- আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
- আমি খাবারটা খেয়ে শুনি স্যার?
- ওকে স্যার।
ভদ্রলোক চুপচাপ বসে। আমার দু গ্রাস অনেক কষ্টে নেমেছে গলা দিয়ে। ঊষার কথা ভেবে নামছিল না খাবার গলা দিয়ে। প্লেটে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে ভদ্র লোককে জিজ্ঞেস করলাম, বলুন স্যার, কি অনুরোধ?
- স্যার আমি আজাদ চৌধুরী। যে লাশ এসেছে সেটা আমার ছেলের। আমার ছেলেটারে বেশি কাটাকাটি কইরেন না। আমার একমাত্র ছেলে। আমি আমার ছেলের খেয়াল কখনো রাখতে পারিনি। ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি এ নারী ও নারীর দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার ছেলেটা আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করায় আমি তার উপর রেগে ছিলাম। কিন্তু আমি তাকে প্রথমবার হাসতে দেখেছি তার বিয়ের পর। তাই আমিও খুশি ছিলাম। কিন্তু ওর শশুরবাড়ি থেকে মেনে নেয়নি! আমার ছেলের বউ যখন তার বাড়িতে যায় ওরা তাকে মেরে ফেলে। তা জানতে পেরে আমার ছেলে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে।
- স্যার আপনি শিক্ষিত মানুষ। আমার যথাসাধ্য কম কাটাছেড়ার চেষ্টা করবো। আপনি শান্ত হউন।
- আমি আপনার পায়ে ধরি স্যার। আমার ছেলেটা বুকে অনেক কষ্ট চেপে বড় হয়েছে। তাকে আর কষ্ট দিয়েন না।
- আমি ফর্ম নিয়ে গেলাম আবারো আমার কর্মশালা! মানে অটোপসি রুমে। ফর্ম টা ডেড বডির কেস ফাইলে এটাচ করতে গিয়ে দেখি তার নাম রাতুল চৌধুরী। আসলে হচ্ছে টা কী! ভদ্রলোকের বর্ণনা, ঊষার বর্ণনা আর সাথে কেস ফাইল এর বর্ণনায় আবারো সামঞ্জস্যতা পেলাম। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার পুত্রবধুর নাম জানেন? তিনি উত্তর দিলেন - ঊষা... মেয়েটা পাহাড়ি।
- আপনি কিভাবে জানলেন ওকে ঊষার বাবা তাকে জোর করে বিষ খাইয়েছে?